মার্কিন নির্বাচন নিয়ে যত কথা

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে দেশ-বিদেশে সাধারণ মানুষের মাঝে অপরিসীম কৌতূহল ও আগ্রহ দেখা যায়। ২০০৮ সালে বারাক ওবামা নির্বাচিত হওয়ার পরপরই আমি তাইওয়ানে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিতে গিয়েছিলাম। তাইপে এয়ারপোর্ট থেকে যে ছেলেটি আমাকে হোটেলে পৌঁছে দিতে এসেছিল, প্রেসিডেন্ট ওবামাকে নিয়ে তার আগ্রহ, প্রত্যাশা ও উত্তেজনা দেখে আমার কাছে মনে হয়েছিল, সে-ই যেন ভোট দিয়ে কৃষ্ণকায় এ ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিটিকে তার নিজের দেশের প্রেসিডেন্ট বানিয়েছে।

 

২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প জেতার পরের মাসেই আমি পোল্যান্ডের স্ট্যাচিনে আরেকটি কনফারেন্সে উপস্থিত ছিলাম। সেখানে বার্লিন থেকে আগত এক জার্মান প্রফেসরের মাঝে একই রকম বাঁধভাঙ্গা কৌতূহল দেখে বিস্মিত হয়েছি। তবে তার কথাবার্তায় স্পষ্ট হয়ে উঠছিল ট্রাম্পকে নিয়ে তাচ্ছিল্য, হাস্যরস ও কৌতুকের এক উপাখ্যান। আমেরিকা নিয়ে বাইরের দুনিয়ায় মানুষের এ আগ্রহের একাধিক কারণ রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে নির্বাচন একটি অপরিহার্য, সাধারণ ও স্বাভাবিক অনুষঙ্গ। এ নিয়ে জনগণের মাঝে কোনো রকম অনিশ্চয়তা, ভয়ভীতি কিংবা শঙ্কা কাজ করে না। নির্বাচনের দিন-তারিখ সাংবিধানিকভাবে আড়াইশ’ বছর আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে। প্রতিটি লিপ ইয়ারের নভেম্বর মাসের প্রথম মঙ্গলবার হল সেই দিন, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! তবে ওই মঙ্গলবার যদি মাসের পয়লা তারিখ পড়ে, সেক্ষেত্রে ভোটাভুটি হয় দ্বিতীয় মঙ্গলবার- ৮ তারিখ। অর্থাৎ মাসের প্রথমদিন কোনো অবস্থাতেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে পারে না।

ভোটের দিনটি নভেম্বরের মঙ্গলবার কেন, তার একটি সুন্দর ব্যাখ্যা আছে। আমেরিকার জাতীয় জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ এ তারিখটি ঠিক হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ, প্রকৃতি, জলবায়ু, ধর্মীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে মিল রেখে। দিনটি নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে রাখা হয়েছে এজন্য যে, এ সময় সারা দেশে মৌসুমের ফসল কাটা শেষ হয়ে যায় এবং ঠাণ্ডা থাকে সহনীয় ও নমনীয় পর্যায়ে, তখনও বরফ, শীতল বাতাস ও হাড়কাঁপানো শীতের তীব্রতা শুরু হয় না।

দিনটি মঙ্গলবার হওয়ার কারণ হল, রোববারে মানুষ চার্চে ব্যস্ত থাকে, সোমবারে ঘোড়া ও ঘোড়ার গাড়ি চড়ে দূরে নির্বাচন কেন্দ্রে যায়, মঙ্গলবারে ভোট দিয়ে বাড়ি ফেরে। যে সময় এ নিয়ম করা হয়েছিল সে সময় এদেশে কৃষ্ণাঙ্গ ও নারীদের ভোটাধিকার ছিল না এবং মোটরগাড়িও বের হয়নি। কিন্তু মাসের পহেলা তারিখ এ নির্বাচনে মানা কেন, সে রহস্যের জট আমি আজ অবধি খুলতে পারিনি।

সংবিধানের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে। এ দুই পদে যারা লড়ে থাকেন, তাদের জন্মসূত্রে আমেরিকার নাগরিকত্ব থাকতে হয় এবং কমপক্ষে ১৪ বছর মার্কিন মাটিতে পদচারণার ইতিহাস লাগে। প্রার্থীদের বয়স ৩৫-এর কম হলে চলে না। প্রেসিডেন্ট হিসেবে কেউ পরপর দুই মেয়াদ পূর্ণ করলে তৃতীয়বারের জন্য তিনি আপনাআপনি খারিজ হয়ে যান।

নির্বাচনের দশ মাস আগে থেকে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ প্রক্রিয়া বড়ই বিচিত্র, দীর্ঘ, ব্যয়বহুল ও জটিল। আরম্ভ হয় ‘আইওয়া’ ‘পার্টি-কোকাস’-এর মধ্য দিয়ে এবং শেষ হয় নির্বাচনের মাস দুয়েক আগে পার্টি কনভেনশনে চূড়ান্ত মনোনয়নের মাধ্যমে। প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট পার্টির ডেলিগেটদের ওপর ন্যস্ত করা আছে। কোন প্রার্থীর পক্ষে কত ডেলিগেট, সেটি বোঝা যায় বাছাইপর্বে রাজ্যে রাজ্যে ‘পার্টি কোকাস’ ও ‘প্রাইমারি’র চড়াই-উতরাই পথ বেয়ে বেয়ে।

ডেলিগেট বাছাইয়ের কাজও সব রাজ্যে এক তরিকাতে হয় না। একেক রাজ্যের একেক নিয়ম। কোনো রাজ্যে পার্টি সদস্যরা ‘ককাস-ভোট’ অথবা দলের ভেতর আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করে নেয় কোন প্রার্থীর পক্ষে কতজন ডেলিগেট- সংক্ষেপে এ পদ্ধতিকে বলে ‘পার্টি ককাস’। কোনো রাজ্যে সাধারণ ভোটাররা ব্যালটের মাধ্যমে ঠিক করে কে কতজন ডেলিগেটের আস্থা পেল- এটাকে বলে ‘প্রাইমারি’।

‘প্রাইমারি’র সুযোগ নিয়ে কখনও কখনও এক দলের ভোটার অন্য দলের দুর্বল প্রার্থীকে ভোট দিয়ে দেয়, যাতে ওই প্রার্থী মনোনয়ন পেলে তার দলের তার প্রিয় প্রার্থী নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে সহজে জিততে পারে। আমেরিকার জাতীয় রাজনীতির পরিভাষায় এটাকে বলে ‘Monkey Business’.

এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করা দরকার। প্রাইমারিতে একজন ভোটার শুধু এক দলের প্রার্থী বাছাইয়ে অংশ নিতে পারে, একই মৌসুমে উভয় দলের হয়ে ভোট দিতে পারে না। বাছাইপর্ব শেষ হলে ডেলিগেটরা পার্টির জাতীয় কনভেনশনে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ভোটের মাধ্যমে দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্ত করে। ডেলিগেটদের সংখ্যা একেক পার্টিতে একেক রকম এবং বছর বছর এর হেরফেরও হতে পারে।

২০২০ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকানদের মোট ডেলিগেট সংখ্যা ২,৫৫১। চূড়ান্ত মনোনয়নের জন্য দরকার কমপক্ষে ১,২৭৬ ডেলিগেট। ডেমোক্রেটদের মোট ডেলিগেট ৩,৯৮৯। নমিনেশনের জন্য পেতে হয় ন্যূনতম ১,৯৯৫ জনের আস্থা। বাছাইপর্বে পোর্টোরিকো, ভার্জিন আইল্যান্ড্স, গোয়াম এবং অন্যান্য মার্কিন টেরিটরির গণপ্রতিনিধিরা অংশ নেয় বটে; কিন্তু মূল নির্বাচনে তাদের কোনো ভোটাধিকার নেই, কারণ তারা ফেডারাল আয়করের আওতার বাইরে। কনভেনশনের আগেই ককাস ও প্রাইমারির মাধ্যমে ডেলিগেটরা তাদের পছন্দের প্রার্থীর প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে যায়।

এতে যদি দেখা যায় কোনো প্রার্থীই প্রয়োজনীয়সংখ্যক ডেলিগেটের আস্থা অর্জন করতে পারেনি, তাহলে পার্টি ডেলিগেটদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অনুমতি দেয়া হয় এবং এ ক্ষেত্রে ডেলিগেটরা ডিগবাজি খায়, দিক-বদল করে এবং নতুন ভোটাভুটির মাধ্যমে মনোনয়ন চূড়ান্ত করে। এ ধরনের মনোনয়নকে বলে ‘Brokered Convention’ Results. ফল যাই হোক, কনভেনশন সেন্টারের আকাশে-বাতাসে টাকা ওড়াউড়ি করে না, তবে টাকার খেলা দেখা যায় তার আগে বড় বড় হোটেলে বর্ণিল ফান্ড-রাইজিং ডিনারে।

প্রার্থীরা নিজের পকেট থেকে এবং ব্যক্তিগত ও পার্টি উদ্যোগে দেশের ভেতরে ফেডারাল আইনানুযায়ী যে চাঁদা তুলে তা দিয়েই নির্বাচনী ব্যয় সংকুলান করে থাকে। আমেরিকার নির্বাচন প্রচারণার সময়ে মাঠে-ময়দানে জনসভা হয় না। মিটিং যা হয়, তার সবই ঘরোয়া। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটরিয়ামে অথবা টাউন হলে গণজমায়েতে বক্তৃতা, বিবৃতি, প্রশ্নোত্তর ইত্যাদি।

বাকি সব প্রচারণা চলে প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। ক্যাম্পেইনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা অনুষঙ্গ হল, নির্বাচনের তিন-চার সপ্তাহ আগে প্রার্থীদের মুখোমুখি জাতীয়ভাবে টেলিভাইজ্ড বিতর্ক-লড়াই। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের মধ্যে পরপর তিনটি বিতর্ক হয় এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট পর্যায়ে হয় কুল্লে একটি। এসব বিতর্ক ও তাদের ফলকে ঘিরে ভোটারদের মধ্যে দেখা যায় দারুণ উৎসাহ, উত্তাপ ও উত্তেজনা। শেষ মুহূর্তে দোদুল্যমান ভোটারদের সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় এসব বিতর্ক বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

এ দেশে কোনো একক ও সমন্বিত সংস্থার অধীনে একই নীতিমালার ভিত্তিতে ভোট হয় না। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে থাকেন একটি লম্বা ও জটিল পরোক্ষ পদ্ধতিতে। গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়ার দেখভালের দায়িত্ব থাকে ৫০টি অঙ্গরাজ্য ও দেশের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি এবং অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। এ ব্যাপারে রাজ্য ও দলগুলোর আছে আলাদা আলাদা আইন, নিয়মনীতি, বিধিব্যবস্থা ও প্রথা।

ভোটার তালিকা প্রণয়ন থেকে শুরু করে পার্টি-ককাস, প্রাইমারি ও মনোনয়ন, নভেম্বরের ভোটগ্রহণ, ভোট গণনা, ফল সার্টিফাই করা ও ঘোষণা দেয়া, ইলেক্টোরাল ভোটগ্রহণ ইত্যাদি যাবতীয় কাজ তারাই করে থাকে স্বতন্ত্র নিয়ম ও ব্যবস্থার অধীনে। শুধু চূড়ান্ত পর্বের ইলেক্টোরাল ভোটের ফল কেন্দ্রীয়ভাবে ঘোষিত হয় জাতীয় কংগ্রেসে। মূল নির্বাচনের আগে আগাম ভোট ও পোস্টাল ব্যালটেরও ব্যবস্থা থাকে, তবে এটিও একেক রাজ্যে একেক নিয়মে চলে। নির্বাচনের আগে এবং ওইদিন ভোটাররা ভোট দেয়; কিন্তু প্রার্থীরা সরাসরি সে ভোট পায় না। ভোট পড়ে তাদেরই দলের মনোনীত ইলেক্টোরাল কলেজের পক্ষে।

এবার বলছি ইলেক্টোরাল কলেজ কী এবং সেটি কীভাবে গঠিত হয় এবং কেমন করে কাজ করে। অনেকে জানেন, আমেরিকার ৫০টি অঙ্গরাজ্য এবং ওয়াশিংটন ডিসি এ নির্বাচনী খেলায় অংশ নিয়ে থাকে। এদেশের কেন্দ্রীয় আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট- ‘প্রতিনিধি পরিষদ’ ও ‘সিনেট’। জনসংখ্যার অনুপাতে ৫০টি অঙ্গরাজ্য থেকে ৪৩৫ জন সদস্য দু’বছর পরপর প্রতিনিধি পরিষদে নির্বাচিত হয়ে থাকে (এখানে একটি বাড়তি তথ্য দেয়া প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি, দেশের রাজধানী শহর ওয়াশিংটন ডিসিতে ছয় লাখের বেশি লোক থাকে; কিন্তু কেন্দ্রীয় আইনসভার কোনো কক্ষেই তাদের কোনো কার্যকর প্রতিনিধিত্ব নেই।

কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদে ভোটাধিকারবিহীন তাদের তিনজন পর্যবেক্ষক কেবল বসতে পারে। সিনেটে তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই, কেন নেই সে আরেক কাহিনী। এসব কথা বলে লেখার পরিসর বাড়াতে চাই না। এছাড়া প্রতি ছয় বছর পরপর পর্যায়ক্রমে রোটেশনের মাধ্যমে ছোট-বড় প্রতিটি অঙ্গরাজ্য থেকে সমানসংখ্যক অর্থাৎ দু’জন করে ১০০ জন সদস্য সিনেটে নির্বাচিত হয়ে আসে।

এ দুয়ের সমষ্টি ৫৩৫, তার সঙ্গে যোগ করা হয় ওয়াশিংটন ডিসির জন্য আরও তিনজন। এ নিয়ে সর্বমোট ৫৩৮ জনই হল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’। সরকারিভাবে তাদের সরাসরি ভোটে দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিটি নির্বাচিত হয়ে থাকেন। জনসংখ্যার ওঠানামার সঙ্গে এ সংখ্যার রাজ্যওয়ারি ব্রেকডাউনে অদলবদল হয়; কিন্তু মূল সংখ্যা ৫৩৮-এ স্থির থাকে।

জাতীয় নির্বাচনের দিন নভেম্বরের পয়লা সপ্তাহে রাত ১০-১১টার দিকেই বেসরকারি ফল জানা যায়। তবে চূড়ান্ত সরকারি ফল ঘোষণার আগে আরও কিছু আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া বাকি থাকে। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় বুধবারের পরের প্রথম সোমবার প্রতিটি রাজ্যের বিজয়ী ইলেক্টোরাল কলেজ নিজ নিজ রাজধানী শহরে বসে আলাদা আলাদা ব্যালটে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টের জন্য ভোট প্রদান করে।

জানুয়ারির প্রথমদিকে বিদায়ী ভাইস প্রেসিডেন্টের সভাপতিত্বে নবনির্বাচিত কংগ্রেসের যৌথসভা বসে। ওই সভায় ইলেক্টোরাল ভোটের সব ব্যালট খোলা হয় এবং জোরে জোরে গোনা হয়। এতে ৫৩৮-এর মাঝে যিনি ২৭০টি অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি ভোট পান তিনি সরকারিভাবে বিজয়ী বলে ঘোষিত হন। যদি দেখা য়ায় কেউই ২৭০ ভোট পাননি, অথবা দু’জনই ২৬৯ ভোট পেয়েছেন, তাহলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদে। এ ভোটে প্রতিটি রাজ্যের একটি মাত্র ভোট থাকে। আর ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর ভাগ্যের ফয়সালা হয় সিনেটে।

সেক্ষেত্রে প্রতি সিনেটারেরও থাকে একটা করে ভোট। দেশের ইতিহাসে এ বিকল্প পদ্ধতিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়েছে মাত্র দু’বার- ১৮০০ ও ১৮২৪ সালে, আর ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়েছে মাত্র একবার ১৮৩৬ সালে। গত নির্বাচন অবধি নিয়ম ছিল, ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ শেষ ধাপে গিয়ে যাকে ইচ্ছা তাকে ভোট দিতে পারে; কিন্তু ২০২০ সালের ২০ জুলাই সুপ্রিমকোর্ট যে রায় দিয়েছেন তাতে এ পথ বন্ধ হয়ে যাবে।

তাই চূড়ান্ত ধাপে গিয়ে বেসরকারি ফল পাল্টে যাওয়ার আর কোনো আশঙ্কা রইল না। বাস্তবতার বিচারে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন; কিন্তু তিনি শপথ নিয়ে হোয়াইট হাউসে ঢোকেন জানুয়ারির ২০ তারিখে। এ সময়ে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেসকে বলে যথাক্রমে ‘লেমডাক’ প্রেসিডেন্ট ও ‘লেমডাক’ কংগ্রেস। ১৯৩৭-এর আগ পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণের দিন-তারিখ ছিল আরও পরে, মার্চের ৪ তারিখ।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট-ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কয়েকটি বিচিত্র বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমত, এটি গণতান্ত্রিক হলেও প্রত্যক্ষ নয়। পপুলার ভোট যে যতই পান না কেন, ইলেক্টোরাল কলেজের অর্ধেকের বেশি না পেলে কিছুই কাজে আসে না। এ সাংবিধানিক মারপ্যাঁচে একজন প্রার্থী বেশি পপুলার ভোট পেয়েও নির্বাচনে হারতে পারেন। ২০০০ সালে জর্জ বুশ জুনিয়রের কাছে এভাবেই আল্ গোরের পরাজয় হয়েছিল।

২০১৬-তে হিলারি ক্লিনটনও সেভাবেই তার স্বপ্নসাধ পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে। আমেরিকার সংবিধানে এ পরোক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে ছোট-বড় সব অঙ্গরাজ্যের ক্ষমতায় ভারসাম্য বজায় রাখার তাগিদে। অন্যথায় প্রেসিডেন্ট যদি কেবল পপুলার ভোটে নির্বাচিত হতেন, তাহলে শুধু ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস, নিউইয়র্ক ইত্যাদি কয়েকটি জনবহুল রাজ্যের দ্বারাই নির্বাচনের ফয়সালা হয়ে যেত। দেশের নির্বাচনে ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ছোট ছোট বাকি রাজ্যগুলোর কোনো মূল্যই থাকত না।

দ্বিতীয়ত, জাতীয় নির্বাচন হলেও এটি কোনো একক জাতীয় নিয়মের ভিত্তিতে হয় না। প্রতিটি অঙ্গরাজ্য তার নিজস্ব নিয়ম ও আইনের ভিত্তিতে ভোটগ্রহণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এমনটি হয় বলে আমার জানা নেই। ‘মেইন’ ও ‘নেব্রাস্কা’ নামের দুটি রাজ্য ছাড়া বাকি সবক’টি অঙ্গরাজ্যে যে প্রার্থী অধিকাংশ পপুলার ভোট পান সে রাজ্যে তার দলের মনোনীত ইলেক্টোরাল কলেজের সবাই জিতল বলে বিবেচিত হয়।

পক্ষান্তরে প্রতিদ্বন্দ্বী পার্টির সব ইলেক্টোরাল কলেজই পরাজিত বলে ধরে নেয়া হয়। ‘মেইন’ ও ‘নেব্রাস্কা’র বেলা এ সরল নিয়ম কাজ করে না। ওই দুই রাজ্যে যে প্রার্থী পপুলার ভোটে জয়লাভ করেন, তিনি পান রাজ্যের দুই সিনেটরের বিপরীতে দু’টো ইলেক্টোরাল কলেজ, বাকিগুলো নির্ভর করে রাজ্যজুড়ে আনুপাতিক প্রাপ্ত ভোটের ওপর। অর্থাৎ যে প্রার্থী যে কয়টি কংগ্রেশনাল ডিস্ট্রিক্টে জেতেন, তিনি পান আরও ততটি ইলেক্টোরাল কলেজ।

তৃতীয়ত, সবাই জানে, আমেরিকার রাজনীতির নিয়ামক দু’টো বড় দল। রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক পার্টি। রিপাবলিকানরা কনজারভেটিভ, তারা কর্পোরেট আমেরিকা এবং সুপার ধনীদের স্বার্থই বেশি করে দেখে, ধর্মীয় বিবেচনায় রক্ষণশীল, মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের দোসর, কারণে-অকারণে যুদ্ধ বাধাতে চায়।

ডেমোক্রেটিক পার্টি লিবারেল, তার সমর্থকরা প্লুরালিজমে বিশ্বাস করে, ইমিগ্র্যান্ট ও ছোট জাতিগোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতিশীল, গরিব ও মধ্যবিত্তদের স্বার্থের ব্যাপারেও অধিক যত্নবান ও সংবেদনশীল। পাঠকরা ভাবতে পারেন, এ অবস্থায় রিপাবলিকান পার্টির তো ১০-১৫ শতাংশের বেশি ভোট পাওয়ার কথা নয়, এ দল অহরহ নির্বাচনে জিতে আসে কী করে? প্রশ্নটা ঠিক। তবে উত্তর হল, তারা জিতে কনজারভেটিভ মূল্যবোধ এবং জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে। এটিও আমেরিকান নির্বাচনের আরেকটি আজব বৈশিষ্ট্য।

এখানে একটি মজার ব্যাপার হল, শুরুতে কিন্তু রিপাবলিকানরা ছিল লিবারেল এবং ডেমোক্রেটরা ছিল কনজারভেটিভ। যেমন ১৮৬০ সালে আব্রাহাম লিংকনের মতো লিবারেল প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন রিপাবলিকান পার্টি থেকেই। এ দুই পার্টির নীতি ও আদর্শে কীভাবে, কখন, কোন পরিস্থিতিতে অদলবদল হল, স্থানাভাবে সে আলোচনা এ লেখার জন্য খুব একটা প্রাসঙ্গিক নয়।

মার্কিন রাজনীতির আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, এ দেশের ভোটাররা জাতীয় নির্বাচনে একদিকে ভোট দেয়, আবার আঞ্চলিক নির্বাচনে দেয় অন্যদিকে। যেমন ক্যালিফোর্নিয়া একটি ব্লু স্টেট, তারা প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনে চোখবুজে ভোট দেয় ডেমোক্রেটিক পার্টিকে, আবার রাজ্য নির্বাচনে কোনো কোনো সময় গভর্নর বানায় রিপাবলিকান পার্টি থেকেও।

চতুর্থত, বছর বছর একটু-আধটু পরিবর্তন হলেও প্রতি নির্বাচনে ‘রেড’, ‘ব্লু’ এবং ‘টস্আপ’ বা ‘সুইং স্টেটের’ এক অদ্ভুত হিসাবের মাধ্যমে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল নির্ধারিত হয়। রেড স্টেট মানে রিপাবলিকান ম্যাজোরিটি, ব্লু স্টেট অর্থাৎ ডেমোক্রেটিক স্ট্রংহোল্ড এবং টস্আপ স্টেট মানে যে কোনো দিকে যেতে পারে। সঙ্গত কারণেই ব্লু এবং রেড জোনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীরা বলতে গেলে ক্যাম্পেইন করেনই না, কারণ এগুলো যার যার বাঁধা ভোট, বাঁধা রাজ্য।

তবে সেসব জায়গায় গভর্নর, সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদের জন্য চুটিয়ে প্রচারণা চলে। ঝুলন্ত কিংবা সুইং স্টেটগুলোতেই চলে প্রেসিডেন্ট পদপ্রত্যাশীদের ফাটাফাটি ক্যাম্পেইন। এ সুইং স্টেটের মধ্যে বড় হল পাঁচটি- ‘প্যানসিলভ্যানিয়া’, ‘ওহাইও’, ‘ফ্লোরিডা’, ‘উত্তর ক্যারোলাইনা’ ও ‘মিশিগান’। বলা হয়ে থাকে, এ পাঁচ রাজ্যের মধ্যে যিনি তিনটি নিজের দিক টানতে পারেন তিনিই শেষ হাসি হাসেন। অর্থাৎ শেষ মুহূর্তে দু’পক্ষই তাদের পুরো প্রচারণাশক্তি নিয়োগ করে থাকে এ পাঁচ রাজ্যের মধ্যে। তবে এ পাঁচে অনিশ্চয়তার কারণে অন্য ছোট ছোট সুইং স্টেটেও ভালো প্রচারণা চলে। আমেরিকা একটি বিশাল ও বিচিত্র দেশ, তার নির্বাচন পদ্ধতি তার চেয়েও জটিল, কঠিন, দুর্বোধ্য ও বৈচিত্র্যময়।

আবু এন এম ওয়াহিদ : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ