১০ বছরে ২৫ বাড়ি ও হাজার কোটি টাকার মালিক এমপি রতন ও তার স্ত্রী ঝুমুর

১০ বছরে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন সুনামগঞ্জ-১ আসনের এমপি ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম-দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও লুটপাটের মাধ্যমে নামে-বেনামে এসব সম্পদ বানিয়েছেন তিনি।

জানা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে এমপি নির্বাচিত হন মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। এরপর ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম-দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি শুরু করেন তিনি। পাশাপাশি সরকারি জমি ও এলাকার মানুষের সম্পত্তি লুটপাট করেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। তার বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগ তদন্ত এবং সম্পদের অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রাথমিক অনুসন্ধানে তার নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এরই মধ্যে দুদকের এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে এমপি রতনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বালু-পাথর উত্তোলন, কয়লা আমদানিকারক সমিতি, বিভিন্ন মার্কেট, বাজার, নানাজনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি করেছেন এমপি রতন। অবৈধভাবে অর্জিত অর্থসম্পদ স্ত্রী মাহমুদা হোসেন লতার নামেও রেখেছেন তিনি। পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজন এবং ভাইয়ের নামেও অবৈধ সম্পত্তি করেছেন রতন।
দুদকে দেয়া অভিযোগে বলা হয়, এমপি রতনের নামে ঢাকা, সুনামগঞ্জ, ধর্মপাশা, নেত্রকোনা ও মোহনগঞ্জে ১৩টি বাড়ি রয়েছে। শুলশান-১ এ ন্যাম ভিলাতে রতনের নামে ফ্ল্যাট রয়েছে। নিজের গ্রাম ধর্মপাশায় ১০ কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করেছেন বিলাসবহুল বাড়ি ‘হাওর বাংলা’। সুনামগঞ্জ শহরের মল্লিকপুরে জেলা পুলিশ লাইন্সের বিপরীতে সাত কোটি টাকায় ‘পায়েল পিউ’ বাড়ি কিনেছেন তিনি।

ধর্মপাশা উপজেলা সদরে তার আরও সাতটি বাড়ি রয়েছে। মোহনগঞ্জ উপজেলা সদরেও রয়েছে দুটি বাড়ি। নেত্রকোনা শহরেও একটি বাড়ি রয়েছে তার। নেত্রকোনা শহরে মা-বাবার নামে মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জন্য প্রায় ৫০ কোটি টাকায় জমি কিনেছেন এমপি রতন। ঢাকার গুলশানের নিকেতনে তার নামে রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট। সহোদর যতন মিয়ার নামে পাঁচশ একর জমি কিনেছেন এমপি রতন। সব মিলে ২৫টির ওপর বাড়ির রয়েছে তার।

এরই মধ্যে গত বুধবার (২০ নভেম্বর) এমপি মেয়াজ্জেম হোসেন রতনের বিরুদ্ধে দুদকে আরেকটি অভিযোগ দিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান সোহেল।
দুদকে দেয়া অভিযোগপত্রে মিজানুর রহমান সোহেল উল্লেখ করেন, গুলশানের মেঘনা ব্যাংকে সাড়ে চার কোটি টাকার এফডিআর করে রেখেছেন এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। নিজ গ্রামে ‘হাওর বাংলা’ নামে যে বিলাসবহুল বাড়ি বানিয়েছেন যার মূল্য ১০ কোটি টাকা।

২০০৮ সালের নির্বাচনী হলফনামায় স্থাবর সম্পদের বিবরণীতে কৃষি-অকৃষি, ব্যক্তিনামে ও যৌথভাবে মোট ৮.২৯ একর সম্পত্তি দেখিয়েছেন এমপি রতন। বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়ে স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৪.৩৬ একর এবং অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৩২.৬০৭৫ একর। পাশাপাশি কৃষিখাত থেকে ২০০৮ সালে যেখানে তার আয় ছিল ৫ হাজার টাকা সেখানে সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে কৃষিখাত থেকে ১২ লাখ ৪৮ হাজার টাকা আয় দেখান তিনি।

নির্বাচন কমিশনে নিজের স্বাক্ষর করা হলফনামায় ২০০৮ সালের ২১ নভেম্বর রতন উল্লেখ করেন, স্ত্রী মাহমুদা হোসেন লতা ৪০ তোলা স্বর্ণের মালিক। রয়েছে ৩৫ লাখ ২৩ হাজার ৭৫৪ টাকার জমি। তবে স্ত্রীর কোনো আয় নেই।

নিজের মোট আয় ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৫৮৩ টাকা। মোট সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি ৮০ লাখ ৭৮ হাজার ৩২২ টাকা। ২০১৩ সালের ৭ নভেম্বর দেয়া হলফনামায় নিজ নামে সম্পদ বৃদ্ধির পাশাপাশি স্ত্রী লতার পরিচয় দেন ব্যবসায়ী। হলফনামায় স্ত্রী লতাকে পায়েল টেক্স লিমিটেডের পরিচালক উল্লেখ করেন।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় দেয়া হলফনামায় তিনি ৫২৩ দশমিক ২৭ একর কৃষিজমি, ৮ দশমিক ২৬ একর পরিমাণের অকৃষি জমি, একটি অ্যাপার্টমেন্ট এবং নিজের ও অংশীদারিত্বের তিনটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকার কথা উল্লেখ করেন তিনি।

এছাড়া সুনামগঞ্জ শহরের মল্লিকপুর এলাকায় ‘পায়েল পিউ’ বাড়ির সম্পত্তির পরিমাণ ৩৫ শতক। সেখানে একটি কলোনি রয়েছে। পুরো বাড়িটির চারপাশে দেয়াল দিয়ে ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। ঢাকার সাভারে রয়েছে তার একটি বাড়ি। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ পৌর শহরে রয়েছে ২১০ শতক জমি। সবমিলে ১০ বছরে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন এমপি রতন।

পাশাপাশি সুনামগঞ্জের হাজিপাড়া এলাকায় দ্বিতীয় জিনাতুল তানভী ঝুমুরের নামে একটি বাড়ি রয়েছে। এর আগে ১০ মাস বিনা অনুমতিতে তাহিরপুর উপজেলার তরঙ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকায় রতনের দ্বিতীয় স্ত্রী সহকারী শিক্ষিকা ঝুমুরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ১০ মাসে একদিন স্কুলে উপস্থিত ছিলেন এমপি রতনের স্ত্রী।

দুদকে দেয়া অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, তাহিরপুর উপজেলার যাদুকাটা নদী, ফাজিলপুর, বড়ছড়া, বাগলী, সুলেমানপুর, ডাম্পের বাজার, আনোয়ারপুর, ঘাগটিয়া, জামালগঞ্জ উপজেলার দুর্লভপুর, লালপুর, আহসানপুর, গজারিয়া, শুকদেবপুর এবং ধর্মপাশা উপজেলার শানবাড়ি পয়েন্ট থেকে বালু, পাথর, কয়লাবাহী নৌযান থেকে মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের লোকজন দৈনিক ৫০ হাজার টাকা চাঁদাবাজি করেন। যার অর্ধেকই পান এমপি রতন।

পাশাপাশি সুনামগঞ্জের বাদাঘাট ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন ও শ্রমিক নেতা সেলিম আহমেদ, ফয়সাল ও বাবুল আলীর মাধ্যমে চাঁদা তোলেন রতন। সুনামগঞ্জের শ্রমিক লীগ নেতা সেলিম আহমদ, নিজাম উদ্দিন চেয়ারম্যান, এমপি রতনের ভাই মোবারক হোসেন যতন ও ধর্মপাশা উপজেলার আজহারুল ইসলাম পিকে দিদার এবং রতনের প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রীর অ্যাকাউন্টে চাঁদার টাকা লেনদেন হয়।

তাহিরপুরে কয়লা আমদানিকারক গ্রুপ নামের প্রতিষ্ঠানটির ব্যানারে শত শত কোটি টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ অনেক দিনের। চাঁদাবাজির টাকা থেকে অর্জিত অর্থে এমপি রতনসহ তার চক্রের প্রায় সবাই সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। চক্রের অন্যতম দুই সদস্য হলেন তাহিরপুর কয়লা আমদানিকারক সমিতির সভাপতি আলকাছ উদ্দিন খন্দকার ও সচিব রাজেশ তালুকদার। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দুদক ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সমিতির শত শত কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দেন কয়লা আমদানিকারক, ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও এলাকাবাসীর পক্ষে সেলিম ইকবাল নামের এক ব্যক্তি।

এদিকে এমপি রতন অবৈধ অর্থ দিয়ে বড় ভাই মোবারক হোসেন মাসুদকে পাইকুরাটি বাজারে জায়গা কিনে একটি বাড়ি ও একটি সমিল করে দিয়েছেন। ছোট ভাই মোজাম্মেল হোসেন রুকনকে নওধারা গ্রামে একটি বাড়ি ও নেত্রকোনা শহরের বিজিবি ক্যাম্পের সঙ্গে চারতলা একটি বাড়ি করে দিয়েছেন। আরেক ছোট ভাই মোবারক হোসেন যতনকে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার হাসপাতাল রোডে জায়গা কিনে বাড়ি করে দিয়েছেন। পাশাপাশি ছোট বোন মিনা আক্তার ও শাকুরা আক্তারকে সুনামগঞ্জে বাড়ি করে দিয়েছেন। তার আরেক ছোট বোন আংরুজা আক্তারকে নেত্রকোনায় জায়গা কিনে বাড়ি করে দিয়েছেন।

এমপি রতনের দুদকে অভিযোগ দেয়া আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান সোহেল বলেন, এর আগেও একবার দুদকে এসব বিষয়ে অভিযোগ করেছিলাম আমি। এবার সুনির্দিষ্ট তথ্য নিয়ে অভিযোগ করলাম। আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন সৈনিক। যখন শুনলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের বিচার করবেন তখন আমি আমার জেলার এমপির বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করেছি। আমি চাই তার বিচার হোক।

তিনি আরও বলেন, এমপি রতনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করায় তাহিরপুর থানা পুলিশের ওসি আমাকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছেন। এরপরও আমি থেমে যাইনি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে যদি আমার মৃত্যু হয়, তাহলে সেই মৃত্যু হবে আমার জন্য আনন্দের।

এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতন বলেন, আমার বিরুদ্ধে দুদকে যে অভিযোগ দেয়া হয়েছে তা দুদক গ্রহণ করেছে কি-না তা দেখতে হবে। তবে এসব বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ