বিশ্বের ভয়ঙ্কর সব অর্থপাচার: ফাঁস হওয়া ‘ফিনসেন ফাইলস’ সম্পর্কে যা জানা দরকার

ঢাকা: দুই লাখ কোটি ডলারের লেন-দেনের এমন কিছু গোপন দলিল ফাঁস হয়েছে, যাতে দেখা যাচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বড় কিছু ব্যাংক কীভাবে অপরাধীদেরকে বিশ্বজুড়ে কালো টাকা পাচার করতে দিয়েছে।

এসব দলিলে আরও দেখা যাচ্ছে রাশিয়ার অলিগার্ক বা ক্ষমতাবলয়ের সঙ্গে যুক্ত ধনী গোষ্ঠীপতিরা কিভাবে নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাচার করেছে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে এই নিষেধাজ্ঞা জারিই করা হয়েছিল যাতে তারা পশ্চিমা দেশগুলোতে টাকা পাচার করতে না পারে।

গত পাঁচ বছর ধরে গোপন লেন-দেন, অর্থ পাচার এবং আর্থিক অপরাধ বিষয়ে যেসব গোপন দলিল ফাঁস হয়েছে, তা থেকে সর্বশেষ এসব ঘটনার কথা জানা গেছে।

ফিনসেন ফাইল‌স কী?
ফিনসেন ফাইলস হচ্ছে ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রায় আড়াই হাজার দলিল। ২০০০ সাল হতে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছিল এসব দলিল। ব্যাংকের গ্রাহকরা আসলে যা করছেন, সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে এসব দলিলে।

আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সবচেয়ে কঠোর গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়, এমন ধরনের দলিল এগুলো।

ব্যাংকগুলো যখন কোন গ্রাহকের আচরণে সন্দেহজনক কিছু দেখে, তখন তারা এরকম রিপোর্ট পাঠায় মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্তু এসব দলিল অপরাধ বা বেআইনি কোন কাজের প্রমাণ নয়।

এই দলিলগুলো ফাঁস করা হয়েছিল বাজফীড নিউজের কাছে। এরপর সারা বিশ্বের অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সঙ্গে এসব দলিল শেয়ার করা হয়। ৮৮টি দেশের ১০৮টি সংবাদ প্রতিষ্ঠানের কাছে এসব দলিল বিতরণ করা হয়। বিবিসির প্যানোরামা অনুষ্ঠানও এই অনুসন্ধান কাজে যুক্ত ছিল।

শত শত সাংবাদিক এই বিপুল পরিমাণ দলিল ঘেঁটে অনুসন্ধান কাজটি চালিয়েছেন। বেশিরভাগ দলিল খুবই টেকনিক্যাল। ব্যাংকগুলো প্রকাশ করতে চায় না, এমন অনেক কাজকর্ম সাংবাদিকরা তাদের অনুসন্ধানের মাধ্যমে উদঘাটন করেছেন।

ফিনসেন এবং সার্স: এ দুটি সংক্ষিপ্ত শব্দের মানে কী
ফিনসেন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ফাইনান্সিয়াল ক্রাইমস ইনভেস্টিগেশন নেটওয়ার্ক(FinCEN) এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এরা যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টে আর্থিক অপরাধ দমনে কাজ করে । মার্কিন ডলারে যত লেন-দেন হয়, সেটা যদি যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও ঘটে থাকে, সেই লেন-দেন নিয়ে প্রশ্ন থাকলে তা ফিনসেনের কাছে পাঠাতে হয়।

সার্স হচ্ছে ইংরেজিতে ‘সাসপিসিয়াস এক্টিভিটি রিপোর্টস’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এরকম সন্দেহজনক লেন-দেনের বিষয়গুলো এই সার্সের মাধ্যমে রেকর্ড করে রাখা হয়। কোন ব্যাংকের যদি তাদের কোন গ্রাহকের লেন-দেন নিয়ে সন্দেহ জাগে, তখন এই সার্স রিপোর্ট লিখে তাদের পাঠাতে হয় মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে।

এর গুরুত্ব কোথায়?
আপনি যদি কোন অপরাধমূলক কার্যক্রম চালিয়ে লাভবান হওয়ার পরিকল্পনা কষে থাকেন, তাহলে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আগে আপনাকে ঠিক করে রাখতে হবে। সেটা হচ্ছে, অর্জিত অবৈধ কালো অর্থ কিভাবে আপনি সাদা করবেন।

মানি লন্ডারিং মানে হচ্ছে কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়া। যেমন, মাদক চোরাচালান বা দুর্নীতির মাধ্যমে পাওয়া অর্থ কোন একটা ব্যাংকের একাউন্টে এমনভাবে জমা করা, যাতে করে আগের অপরাধের সঙ্গে এই অর্থের কোন যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া না যায়।

ধরা যাক আপনি একজন রুশ অলিগার্ক বা ধনী গোষ্ঠীপতি ব্যবসায়ী। আপনার বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, যাতে আপনি এসব দেশে অর্থ আনতে না পারেন। এখন অর্থ পাচার করতে গেলে, আপনাকে একই ধরনের মানি লন্ডারিং এর আশ্রয় নিতে হবে।

নিয়ম ভেঙ্গে কোন গ্রাহক যেন এভাবে অর্থ পাচার করতে না পারে, বা কালো অর্থ সাদা করতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করা ব্যাংকগুলোর কাজ।

লাখো কোটি টাকা পাচারের তথ্য কতটা বিশ্বাসযোগ্য?
আইন অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে অবশ্যই জানতে হবে তাদের গ্রাহক কারা। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একটা সার্স রিপোর্ট পাঠিয়ে দিলেই ব্যাংকগুলোর দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। গ্রাহকদের কাছ থেকে কালো অর্থ নেয়া অব্যাহত রেখে তারা এটা আশা করতে পারে না যে কর্তৃপক্ষই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। যদি ব্যাংকগুলোর কাছেই কোন অপরাধমূলক কাজের প্রমাণ থাকে, তখন তাদেরই এরকম লেন-দেনে বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচি‌ৎ।

ফার্গাস শিয়েল কাজ করেন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসের (আইসিআইজে) সঙ্গে। তিনি বলছেন, বিশ্বজুড়ে কী বিপুল পরিমাণ কালো অর্থ পাচার হচ্ছে তার ওপর দৃষ্টিপাতের সুযোগ করেছ দিয়েছে এই ফাঁস হওয়া দলিলগুলো।

তিনি বলেন, এই লেন-দেনের সঙ্গে কি বিপুল অংকের অর্থ জড়িত, সেটাও তুলে ধরেছে এসব দলিল।

ফিনসেন ফাইলসের দলিলগুলোতে আছে প্রায় দুই লক্ষ কোটি ডলারের লেন-দেনের কথা। অথচ ২০০০ সাল হতে ২০০১৭ সাল পর্যন্ত যত সার্স রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে, এই ফিনসেন ফাইলস কিন্তু তার একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ।

ফাঁস হওয়া দলিল থেকে যা জানা গেছে:
এইচএসবিসি জালিয়াত চক্রকে চুরি করা কোটি কোটি ডলার পাচার করতে দিয়েছে। মার্কিন তদন্তকারীদের কাছ থেকে এই স্কিমটি যে একটি ধাপ্পাবাজি সেটা জানার পরও তারা এই লেন-দেন হতে দিয়েছে।

জেপি মর্গান একটি কোম্পানিকে লন্ডনের একটি একাউন্ট ব্যবহার করে একশো কোটি ডলার লেন-দেন করতে দিয়েছে। অথচ জেপি মর্গান জানতোই না কোম্পানিটির মালিক কে। পরে জেপি মর্গান জানতে পারে যে এই কোম্পানিটির মালিক হয়তো এমন এক অপরাধী গোষ্ঠির নেতা, যার নাম আছে যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই এর সবচেয়ে দুর্ধর্ষ দশ ফেরারি আসামীর তালিকায়।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ একজন সহযোগী তার বিরুদ্ধে জারি করা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে লন্ডনের বার্কলেজ ব্যাংককে ব্যবহার করেছেন। অথচ এই নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্যই ছিল তিনি যেন পশ্চিমা বিশ্বের কোন আর্থিক সেবা ব্যবহার করতে না পারেন। এই পাচার করা অর্থ দিয়ে শিল্পকর্ম কেনা হয়েছে।

ফিনসেনের ইন্টেলিজেন্স বিভাগের মতে, যুক্তরাজ্য এখন সাইপ্রাসের মতোই উচ্চ ঝুঁকির এলাকা। যুক্তরাজ্যে নিবন্ধিত যে পরিমাণ কোম্পানির নাম সার্স রিপোর্টে এসেছে, সেই কারণেই এটা হয়েছে। ফিনসেন ফাইলে যুক্তরাজ্যের তিন হাজারের বেশি কোম্পানির নাম আছে। বিশ্বের আর কোন দেশের এত বেশি কোম্পানির নাম ফিনসেন ফাইলে নেই।

ইরানের বিরুদ্ধে যে নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে, সেটি এড়াতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি কোম্পানি সহায়তা করছিল। কিন্তু এনিয়ে সতর্ক করে দেয়ার পরও সংযুক্ত আরব আমিরাতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোন ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়।

সংঘবদ্ধ অপরাধী গোষ্ঠী, সন্ত্রাসবাদ এবং মাদক চোরাচালানকারীদের কালো টাকা পাচার করতে দিয়েছে ডয়েচে বাংক।

জর্ডানের একটি ব্যাংক আরব ব্যাংকে‌র গ্রাহকের একাউন্ট এক দশকের বেশি সময় ধরে সন্ত্রাসবাদের অর্থ যোগানোর কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। অথচ স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক তাদের অর্থ লেন-দেন করতে দিয়েছে।

এবারের ফাঁস হওয়া দলিল কেন আলাদা
সাম্প্রতিক বছর গুলোতে এরকম আরও অনেক আর্থিক দলিল ফাঁস হয়েছে। এর মধ্যে ছিলঃ

২০১৭ সালের প্যারাডাইস পেপার্স: অফশোর আইনি সেবা প্রতিষ্ঠান অ্যাপলবি এবং কর্পোরেট সেবা প্রতিষ্ঠান এস্টেরার বিপুল পরিমাণ গোপন দলিল ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। এই দুটি প্রতিষ্ঠানই অ্যাপলবি নামে কার্যক্রম চালাতো। তবে ২০১৬ সালে এস্টেরা স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ শুরু করে। ফাঁস হওয়া দলিল থেকে জানা গিয়েছিল রাজনীতিক, নামকরা তারকা এবং ব্যবসায়ী নেতাদের আর্থিক লেন-দেনের খবর।

২০১৬ সালের পানামা পেপার্স: বিশ্বের ধনী লোকজন কিভাবে অফশোর প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে কর ফাঁকি দেয় তা প্রকাশ পেয়েছিল আইনি প্রতিষ্ঠান মোসাক ফনসেকার ফাঁস হয়ে যাওয়া দলিলপত্রের মাধ্যমে।

২০১৫ সালে সুইস লিকস: এইচএসবিসির সুইস প্রাইভেট ব্যাংকের কিছু দলিল ফাঁস হয়ে যায়। এতে দেখা যায় এই ব্যাংকটি কীভাবে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকিং গোপনীয়তা বিষয়ক আইন ব্যবহার করে তাদের গ্রাহকদের কর ফাঁকি দিতে সাহায্য করছিল।

২০১৪ সালের লাক্স-লিকস: একাউন্টিং প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়াটারহাউসকুপার্সের কিছু দলিল ফাঁস হলো, যাতে দেখা গেল বড় বড় কোম্পানি লাক্সেমবার্গের কর ব্যবস্থাকে ব্যবহার করছে যাতে করে তাদের কর প্রদানের অংক অনেক কমিয়ে আনা যায়।

তবে ফিনসেন ফাইলস আগের ফাঁস হওয়া দলিলপত্র থেকে একটু আলাদা। এগুলো কেবল একটি বা দুটি কোম্পানির দলিলপত্র নয়। এসব দলিল এসেছে বহু ব্যাংক থেকে।

এই দলিলপত্রে ধরা পড়েছে অনেক সন্দেহজনক লেন-দেন যার সঙ্গে জড়িত অনেক ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান। যেসব ব্যাংকের মাধ্যমে এসব লেন-দেন হয়েছে, তাদের চোখে বিষয়টি ধরা পড়ার পরও কেন তারা ব্যবস্থা নেয়নি, সে প্রশ্নও উঠেছে।

ফিনসেন বলেছে, এসব দলিল ফাঁস হওয়ার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে। এতে তাদের নিজস্ব তদন্তে বিঘ্ন হতে পারে। যেসব প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি এসব রিপোর্ট পাঠিয়েছে তাদের নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়তে পারে।

ফিনসেন অবশ্য গত সপ্তাহে অর্থ পাচার-বিরোধী কার্যক্রম ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে এক প্রস্তাব ঘোষণা করেছে।

যুক্তরাজ্যও ঘোষণা করেছে যে, জালিয়াতি এবং অর্থ পাচার প্রতিরোধে তারা কোম্পানি নিবন্ধন সংক্রান্ত তথ্যের নিয়মনীতি সংস্কার করে ঢেলে সাজাচ্ছে।

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ