দিল্লি জামে মসজিদ: মোঘল স্থাপত্যকলার অনন্য নিদর্শন যে মসজিদ

লিখেছেন মোঃ ফাহিম খান

ভারতবর্ষের বুকে মোঘল সূর্যাস্ত হয়েছে কয়েকশত বছর হয়ে গেল। এককালের প্রতাপশালী মোঘলরা আজ আর ভারতের বুকে জীবিত নেই। পৃথিবীখ্যাত সম্রাট বাবর, হুমায়ুন, শাহজাহান, আওরঙ্গজেব, আকবরদের বিশাল সাম্রাজ্য কালের বিবর্তনে বিলীন হয়ে গেছে। তবে সেদিনের সম্রাট, সাম্রাজ্য, ক্ষমতা হারালেও মোঘলদের ছাপ ভারতবর্ষ থেকে একেবারে হারিয়ে যায়নি। অধুনা ভারতের প্রতিটি প্রদেশে মোঘলদের কীর্তি যুগ যুগ ধরে টিকে আছে। ভারতের রাজধানী শহর দিল্লির কথাই ধরা যাক। বিখ্যাত লাল কেল্লা, দিল্লি জামে মসজিদ, জাফর মহল, হুমায়ুনের সমাধিক্ষেত্র, খান-ই-খানার সমাধি, ফতেহপুর মসজিদসহ শত শত স্থাপনাশৈলী হারানো মোঘল সাম্রাজ্যকে গৌরবের সাথে প্রতিনিধিত্ব করে আসছে। ইতিহাস এবং অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর বদৌলতে এসব স্থাপনা সারাবিশ্বের পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।

দিল্লীতে নির্মিত এসব স্থাপনার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নাম নিলে প্রথমেই আসবে দিল্লি জামে মসজিদের নাম। প্রিন্স অফ বিল্ডার্স হিসেবে পরিচিত সম্রাট শাহজাহানের আমলে নির্মিত এই মসজিদটি শুধু ভারতীয় উপমহাদেশ নয়, পুরো পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ।

দিল্লি জামে মসজিদ

ভারতের রাজধানী দিল্লির পুরাতন দিল্লি অংশে অবস্থিত ‘মসজিদ-ই-জাহান নুমা’, যা দিল্লি জামে মসজিদ নামে সমধিক পরিচিত। মসজিদ-ই-জাহান নুমা শব্দটির অর্থ ‘বিশ্বের প্রতিফলন ঘটে যে মসজিদে’। ১৭শ শতাব্দীতে সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশে নির্মিত এই সুবিশাল মসজিদের উঠানে দাঁড়ালেই এই নামকরণের সার্থকতা পাওয়া যায়। বিশাল মসজিদ যেন আমাদের পৃথিবীরই প্রতিবিম্ব। আর এই সুবিস্তৃত জগতের মাঝে অতি ক্ষুদ্র অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে আছে মানুষ। দিল্লি জামে মসজিদ যুগ যুগ ধরে ভারতীয় মুসলিমদের আদর্শের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।

দিল্লি জামে মসজিদ: Image Source: Tech Hub

ধর্মীয় গুরুত্বের বাইরেও এটি দিল্লি পর্যটনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। আপনি দিল্লি বেড়াতে যাবেন অথচ জামে মসজিদ দেখে আসবেন না, তা হয় না। ঘনবসতিপূর্ণ দিল্লির বুকে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এই মসজিদটির অবস্থান চাঁদনি চকের পাশে অবস্থিত লাল কেল্লার বিপরীতে। জেনে রাখা ভালো, ভারতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতীক এই লাল কেল্লাও সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশেই নির্মিত হয়েছে। দিল্লি জামে মসজিদের স্থাপত্যশৈলীর অনুকরণেই সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে পাকিস্তানের লাহোরে অবস্থিত বাদশাহি মসজিদ নির্মিত হয়েছে।

বাদশাহি মসজিদ, লাহোর: Image Source: Daily Times Pakistan

জামে মসজিদ নির্মাণ

তৎকালীন শাহজাহানাবাদ (বর্তমান পুরাতন দিল্লি) শহরে সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশে ১৬৪৪ সালে নির্মাণকাজ শুরু হয় দিল্লি জামে মসজিদের। প্রায় ৫ হাজার কারিগরের সহায়তায় দিনরাত পরিশ্রমের পর নির্মিত হয় এই মসজিদ। জেনে অবাক হবেন, এই মসজিদ নির্মাণ করতে লেগেছিল দীর্ঘ ১২ বছর। অর্থাৎ, ১৬৫৬ সালে এই মসজিদের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত। এই মসজিদের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেছিলেন স্বয়ং শাহজাহান। মসজিদ কাজ তদারকির দায়িত্বে ছিলেন শাহজাহানের প্রধানমন্ত্রী সাদুল্লাহ খান। মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষে শ্রমিকদের মজুরি কম ছিল। তারপরেও এই মসজিদ নির্মাণ করতে সম্রাটকে খরচ করতে হয়েছিল বেশ বড় অঙ্কের অর্থ। বর্তমান ভারতের হিসাবে সেই অর্থ দাঁড়াবে প্রায় ১০ লাখ রুপি

সম্রাট শাহজাহান; Image Source: Wikimedia Commons

১৬৫৬ সালের ২৩ জুলাই পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন ঈদের নামাজ আদায়ের মাধ্যমে শুভ উদ্বোধন হয়েছিল এই ঐতিহাসিক মসজিদের। উদ্বোধন অনুষ্ঠানের জন্য সম্রাট শাহজাহান সুদূর উজবেকিস্তানের বুখারা নগরী থেকে একজন প্রসিদ্ধ ইমামকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। তখনকার সময় ইসলামী জ্ঞানচর্চার গুরুত্বপূর্ণ নগরী ছিল বুখারা। বুখারার ইমাম আব্দুল গফুর শাহ বুখারী সম্রাটের নিমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে প্রায় ১,৮০৭ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে দিল্লি এসে পৌঁছান। ইমাম আব্দুল গফুর দিল্লি জামে মসজিদের প্রথম ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরবর্তীতে মসজিদটির ইমাম হিসেবে আব্দুল গফুরের বংশধরগণ নিযুক্ত হতে থাকেন। মসজিদের বর্তমান ইমাম মাওলানা সৈয়দ আহমেদ বুখারীও উনার বংশধর।

ইমাম সৈয়দ আহমেদ বুখারী; Image Source: The Financial Express

স্থাপত্যশৈলী

লাল বেলে পাথরে তৈরি মসজিদ; Image Source: Wikimedia Commons

মোঘল আমলে নির্মিত শত শত স্থাপনার মধ্যে দিল্লির জামে মসজিদের স্থাপত্যশৈলী ছিল অনন্য। সম্রাট শাহজাহানের বাসভবন লাল কেল্লার মতোই এই মসজিদ নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছিল লাল বেলে পাথর এবং সাদা মার্বেল। জৈন, ভারতীয় এবং ইসলামি স্থাপত্যবিদ্যার অপূর্ব সংমিশ্রণে নির্মিত এই মসজিদ যেন বহু সংস্কৃতির ধারক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদ এলাকার দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬১ ফুট এবং প্রস্থ ৯০ ফুট। মসজিদে প্রবেশের জন্য নির্মিত হয়েছে ৩টি নান্দনিক প্রবেশদ্বার। প্রতিটি প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশের সময় আপনাকে পাড়ি দিতে হবে গড়ে ৩৫টি সিঁড়ি, কারণ মসজিদটি ভূমি থেকে প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতায় নির্মিত হয়েছে। উঁচু ভূমিতে নির্মাণের কারণে অনেক দূর থেকে এই মসজিদের কাঠামো চোখে পড়ে। এছাড়া এই মসজিদে রয়েছে ৩টি মার্বেলের তৈরি গম্বুজ, ৪টি টাওয়ার এবং ২টি মিনার। মসজিদের বিস্তৃত নামাজের স্থানে একসাথে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ নামাজ আদায় করতে সক্ষম হয়। এটি ভারতের বুকে সবচেয়ে বড় জামাতের স্থান। মসজিদ চত্বরে মুসলিম নারীদের নামাজ পড়ার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে।

দিল্লি জামে মসজিদের সিঁড়ি; Photograph: Gavin Hellier/robertharding
মিনার থেকে এক নজরে দিল্লি নগরী; Photograph: Syamantak Ghosh
মসজিদের মিনার; Image Source: Travel Adventures

মসজিদের পূর্বদিকের প্রবেশদ্বারটিকে রাজকীয় দ্বার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কারণ সম্রাট শাহজাহান এই দ্বার দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করতেন। মসজিদের ২টি মিনার ৫ তলা বিশিষ্ট এবং বেলকনিযুক্ত। মিনারগুলোর গড় উচ্চতা প্রায় ১৩০ ফুট। মিনারের সবচেয়ে উঁচুতে উঠতে হলে আপনাকে ১৩০টি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে। মিনারগুলোর উঁচুতে উঠলে আপনি পুরো দিল্লিকে এক নজরে উপভোগ করতে পারবেন। মসজিদের মেঝেগুলো কালো এবং সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে নির্মিত। মসজিদের অভ্যন্তরের প্রাচীরে শোভা পাচ্ছে ক্যালিগ্রাফি, ফুলের নকশা, ফারসি শিলালিপি, ইসলামি ধাঁচের নকশা। মসজিদের ভেতর হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর স্মৃতিবিজড়িত দাঁড়ি মোবারকের একটি লাল চুল, মার্বেল পাথরের উপর পদচিহ্ন এবং হরিণের চামড়ার উপর লেখা পবিত্র কোরআন সংরক্ষিত রয়েছে।

দেয়ালে কোরআনের আয়াত; Image Source: Wikimedia Commons

ইতিহাসের পাতায় দিল্লি জামে মসজিদ

মোঘল আমল থেকে বর্তমান পর্যন্ত ইতিহাসের নানা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সাক্ষী এই জামে মসজিদ। সিপাহী বিদ্রোহের পূর্বে মসজিদের সাথে একটি মাদরাসা সংযুক্ত ছিল। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার জামে মসজিদ ক্রোক করে দেয়। এরপর সেখানে ব্রিটিশ সেনা মোতায়েন করা হয়। দুঃখজনকভাবে, মাদরাসাটি তখন ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ব্রিটিশ সরকার মসজিদ ধ্বংসের পরিকল্পনা করলেও মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিবাদের কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি।

মসজিদে জামাত আদায়ের দৃশ্য; Image Source: DNA India

মোঘল আমলের বিভিন্ন কাঠামো কালের বিবর্তনে মলিন এবং ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ায় গত শতাব্দীতে মসজিদ মেরামত এবং সংস্কারের কাজ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালে হায়দ্রাবাদের নিজামের নিকট মসজিদের এক-চতুর্থাংশ সংস্কারের জন্য প্রায় ৭৫ হাজার রুপি অনুদান চাওয়া হয়। পরবর্তীতে নিজাম পুরো মসজিদ সংস্কারের জন্য ৩ লাখ রুপি অর্থ সাহায্য দেন।

পাখির চোখে জামে মসজিদ; Image Source: Kashmir Observer

সন্ত্রাসী হামলার কবলে

দিল্লি জামে মসজিদের যেমন আছে গৌরবের ইতিহাস, তেমনই এর প্রাচীরেও মিশে আছে সন্ত্রাসীদের কালো থাবা। ২০০৬ সালে দিল্লি জামে মসজিদ প্রাঙ্গনে দুটি ভয়াবহ বোমা হামলা হয়। সেবছর ১৪ এপ্রিল দিনটি ছিল ঈদে মিলাদুন্নবীর পর প্রথম শুক্রবার। সে কারণে সাধারন জামাতের চেয়েও প্রায় ১ হাজার বেশি মুসল্লি সেদিন জুমা’র নামাজ আদায় করতে মসজিদে এসেছিলেন। বিকেল ৫টা বেজে ২৬ মিনিটে মসজিদ প্রাঙ্গনে প্রথম বোমা বিস্ফোরণ হয়। এর ৭ মিনিট পর আবার বোমা ফাটলে মুসল্লিদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সেদিনের ঘটনায় ১৩ জন মুসল্লি আহত হন। তবে মসজিদের কাঠামোর কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

২০১০ এর সন্ত্রাসী হামলার দৃশ্য; Image Source: New York Times

২০১০ সালে ফের আক্রমণের শিকার হয় জামে মসজিদ। ১৯ সেপ্টেম্বর দুই বন্দুকধারী একটি মোটরসাইকেলে চড়া অবস্থায় একটি ট্যুরিস্ট বাসকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। এই ঘটনায় ২ জন তাইওয়ানিজ নাগরিক আহত হয়। তবে এসব ঘটনার পরেও দিল্লি জামে মসজিদের গুরুত্ব কমেনি। এখনও পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ হিসেবে এই মসজিদ সমাদৃত হয়। বর্তমানে মসজিদটির তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দিল্লি ওয়াকফ বোর্ড দায়িত্বরত আছে।

মসজিদ এলাকায় পর্যটন

একবিংশ শতাব্দীতে দিল্লিতে ভ্রমণে আসা পর্যটকরা একবার হলেও এই মসজিদ ঘুরে দেখেন। এর ফলে এটি দিল্লির অন্যতম প্রধান পর্যটন স্থানে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা এই মসজিদে নামাজ পড়তে আসেন। অমুসলিমরাও এখানে ভিড় জমান অসাধারণ স্থাপত্যকলার চাক্ষুস সাক্ষী হতে। মসজিদ চত্বরে তাই পর্যটকদের আনাগোনা নজরে আসে। নির্দিষ্ট স্থানে বনভোজনের মতো ছোটখাট আয়োজন করার ব্যবস্থাও রয়েছে এখানে। মসজিদের দক্ষিণের মিনারটি ফি প্রদান ভিত্তিতে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। সাঁঝের দিকে মাগরিবের নামাজের পর মসজিদে আলোকসজ্জা করা হয়। এই আলোকসজ্জা দেখার জন্য অনেকে মসজিদে আসেন।

পর্যটকদের আনাগোনা; Photograph: Shraddha Gosavi / TripSavvy

মসজিদ ছাড়াও এর আশেপাশে ২ কিলোমিটারের মধ্যে বেশ কিছু স্থাপনায় ভ্রমণ করেন পর্যটকরা। চাঁদনি চক বাজার, লাল কেল্লা, ফতেহপুর মসজিদ,গৌরি শংকর মন্দির, স্টিফেন এর গির্জা, গুরুদুয়ারা শিশগঞ্জ সাহেবসহ বিভিন্ন বিখ্যাত স্থানে পর্যটকদের আনাগোনা দেখা যায়। মসজিদ থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরত্বে বিখ্যাত ইন্ডিয়া গেট অবস্থিত।

মসজিদে আলোকসজ্জা; Photograph: Amin Ali / Times of India

দিল্লি জামে মসজিদ শুধু ভারত নয়, সারা পৃথিবীর মুসলিমদের নিকট একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থান। সম্রাট শাহজাহানের দর্শন ছিল এই মসজিদকে সারাবিশ্বের মুসলিমদের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা। এখনও দুই ঈদের জামাত আদায়ের জন্য সারা ভারত থেকে মুসল্লিগণ দিল্লি ভ্রমণ করেন জামে মসজিদ প্রাঙ্গনে। এর অনন্য ইতিহাস এবং স্থাপত্যকলা একে ধর্মমত নির্বিশেষে সকলের নিকট গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। ইতিহাসের পাতায় অনন্তকাল পর্যন্ত সম্রাট শাহজাহানের অনন্য সৃষ্টি হিসেবে এই মসজিদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ