কমলা হ্যারিস: পাঁচটি না-জানা গল্প

হোয়াইট হাউসের দৌড়ে ট্রাম্পের সঙ্গে লড়বেন যিনি সেই জো বাইডেন তাঁর ‘রানিং মেট’ হিসাবে বেছে নিয়েছেন এমনই এক মহিলাকে যাঁর সব থেকে ফেভারিট ডিশের মধ্যে পড়ে ইডলি এবং সম্বর। স্বাভাবিক, শ্যামলা গোপালন হ্যারিসের মেয়ে কমলাদেবী হ্যারিস সংক্ষেপে কমলা হ্যারিস কখনওই তাঁর নিজের শিকড়কে ভোলেননি। সত্যি বলতে ভুলতে চানওনি কখনও। আত্মকথায় লিখেছেন, ‘শ্যামলা গোপালন হ্যারিসের মেয়ে— এই পরিচয়টুকুর থেকে বড় কোনও সম্মান পৃথিবীতে হতে পারে বলে আমি বিশ্বাসই করি না।’ রূপকথার মতো উড়ান যাঁর জীবনে বার বার দেখা দিয়েছে, আসুন সেই কমলা হ্যারিস সম্পর্কেই কয়েকটি প্রায় না-জানা গল্প শুনে নেওয়া যাক।

এক, মায়ের ছাপ তো তাঁর জীবনে সব থেকে গভীর ঠিকই, কিন্তু কমলা ভুলতে পারেন না তাঁর দাদু-দিদিমার কথাও। একটি সাক্ষাৎকারে একবার নিজেই জানিয়েছিলেন তাঁর একেবারে ছোটবেলার প্রিয় কিছু স্মৃতির কথা। মাদ্রাজ তখনও চেন্নাই হয়নি, দু’বছর অন্তর বাবা-মাকে দেখতে আসতেন শ্যামলা গোপালন, সঙ্গে দুই মেয়ে কমলা এবং মায়া। ছোট্ট কমলার মনে পড়ে কী ভাবে রোজ সকালবেলা বন্ধুদের সঙ্গে সমুদ্রের তীরে হেঁটে বেড়াতেন তার দাদু পিভি গোপালন। পিভি নিজে দেশের জন্য লড়েছেন, স্বাধীন দেশে প্রশাসনের খুবই উঁচু দায়িত্ব সামলেছেন এবং সারা জীবন ধরেই তাঁর লড়াই ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে। সেই মর্নিং ওয়াকের সময় বাচ্চা কমলা থাকত দাদুর পাশে আর চুপ করে শুনত কী ভাবে দাদু এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীরা সুবিচার নিয়ে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই নিয়ে আর রাজনীতির নানা ওঠাপড়া নিয়ে কথা বলছেন। কমলা পরে বলেছেন, সেই সব মর্নিং ওয়াক থেকে জীবনে খুব দামি একটা শিক্ষা পেয়েছিলেন তিনি। সততার জন্য লড়াই করার শিক্ষা। পাশাপাশি দিদিমা রাজম গোপালন-এর ছায়াও কমলার স্বাধীনচেতা চরিত্রের মধ্যে স্পষ্ট। মাত্র বারো বছরে বাগদত্তা এবং ষোলোয় পৌঁছে বিয়ে হয়ে যাওয়া রাজম স্রেফ ঘরের মধ্যেই আটকে রাখেননি নিজেকে। যে সব মেয়ে অত্যাচারের শিকার, তাদের জন্য বার বার সরব হয়েছেন। গত শতকের চল্লিশের দশকে রাজম নিজে ফোক্স ভাগেন গাড়ি চালিয়ে ঘুরে বেড়াতেন চতুর্দিক, গরিব মেয়েদের শেখাতেন জন্ম নিয়ন্ত্রণের নানা রকম সুবিধা। আত্মকথায় কমলা লিখছেন— ‘আমার দাদু তো ঠাট্টা করে বলতেন দিদিমার এই অ্যাকটিভিজিমের ঠেলায় তার কেরিয়ারটাই না বরবাদ হয়ে যায়। দিদিমা অবশ্য সে সব কথায় পাত্তাই দেননি কোনও দিন।’

দুই, আমেরিকা যখন সিভিল রাইটস আন্দোলনে উত্তাল, তখনই আস্তে আস্তে বড় হচ্ছেন কমলা। বাবা-মা সেই ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে হাঁটতেন মিছিলে, জড়ো হতেন বিভিন্ন জমায়েতে। কমলা জানাচ্ছেন, তাঁর একেবারে ছোটবেলার ঝাপসা স্মৃতির মধ্যে আছে চারিদিকে অসংখ্য পা হেঁটে চলেছে সারিবদ্ধ ভাবে। আর সেই মিছিল থেকে নানা রকম স্লোগান উঠছে। মা শ্যামলা জানিয়েছিলেন তাঁর বড় মেয়েটি অর্থাৎ কমলার মুখে যখন সবে বুলি ফুটেছে, তখন সে মাঝেমাঝেই কান্নাকাটি করত আর কী চাই জিজ্ঞাসা করলে ঠোঁট ফুলিয়ে আধো আধো গলায় বলত, ‘ফিদম’।


তিন, বাবা জামাইকান মা ভারতীয়, ফলে জন্মসূত্রে নানা রকম সংস্কৃতির মধ্যে মেলামেশা করার সুযোগ পেয়েছিলেন কমলা। ২০০৩-এ দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি সাফ জানিয়েছিলেন, ‘আমার সব বন্ধুরাই ছিল ব্ল্যাক আর আমরা একসঙ্গে জড়ো হয়ে নানা রকম ভারতীয় খাবার-দাবার রান্না করতাম। হাতে হেনাও করতাম খুব মজা করে।’ এমন মিশ্র সংস্কৃতির কারণে দুই বোন কমলা ও মায়া কখনও হয়তো ব্ল্যাক ব্যাপটিস্ট গির্জায় গিয়ে কয়্যারে গেয়েছে আবার ফিরে এসেই মার হাত ধরে গুটিগুটি পায়ে হাঁটা দিয়েছে হিন্দু কোনও মন্দিরের দিকে। এই নানামুখী সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠার জন্যেই কমলার নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর সুযোগও হয়েছিল। কখনও বাবার সঙ্গে জামাইকা, কখনও মায়ের সঙ্গে ভারত। এ ব্যাপারে একটি ইন্টারেস্টিং গল্প বলেছিলেন একবার শ্যামলা গোপালন নিজেই। সানফ্র্যান্সিসকো ম্যাগাজিনকে তিনি জানিয়েছিলেন কমলা যখন সবে ফার্স্ট গ্রেডের পড়ুয়া তখন সে স্কুলেরই এক শিক্ষিকা শ্যামলাকে ডেকে বলেছিলেন, ‘জানেন, আপনার মেয়ের কল্পনাশক্তি দারুণ। যখনই ক্লাসে দূরের কোনও না কোনও দেশের কথা হয়, তখন ও ঠিক মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ আমি তো ওখানে গিয়েছিলাম।’ তখন শ্যামলা সেই শিক্ষিকাকে জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন যে বাচ্চা মেয়েটি মনগড়া কিছু বলেনি, কারণ সত্যিই সে তত দিনে ভারত, ইংল্যান্ড, ক্যারিবিয়ান আইল্যান্ড, আফ্রিকা এমন নানা জায়গা ঘুরে ফেলেছে।

চার, কমলা হ্যারিস তখন সান ফ্র্যান্সিসকোয় ডিসট্রিক্ট অ্যাটর্নি পদের জন্য প্রচার শুরু করেছেন। সে সময় তিনি জানান, কোনও মামলাতেই আর মৃত্যুদণ্ড কখনও চাইবেন না। তিনি ডিসট্রিক্ট অ্যাটর্নি নির্বাচিত হওয়ার কয়েক মাস পরেই মর্মান্তিক একটা কাণ্ড ঘটে গেল। কর্তব্যরত অবস্থায় গুন্ডাদের গুলিতে নিহত হলেন তরুণ পুলিশ অফিসার আইজাক এসপিনোজা। হ্যারিস জানিয়ে দিলেন, কাণ্ডটি খুবই দুঃখজনক কিন্তু তিনি নিজের ঘোষিত নীতি থেকে সরবেন না। অর্থাৎ খুনিদের মৃত্যুদণ্ড চাইবেন না কিন্তু এমন যাবজ্জীবন কারাবাস চাইবেন যেখানে প্যারোলে বাইরে আসার কোনও সুযোগ থাকবে না। চারিদিকে হইচই পড়ে গেল। পুলিশ ইউনিয়ন এবং এসপিনোজার পরিবার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল, ক্যালিফোর্নিয়ার কিছু নামজাদা রাজনীতিবিদও চেঁচামেচি শুরু করলেন। এসপিনোজার শেষকৃত্যে জনৈক সেনেটর যিনি এক সময় সান ফ্র্যান্সিসকোর মেয়রও ছিলেন, সটান ঘোষণা করলেন, ‘এই ঘটনা মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি তো বটেই, এবং এই জাতীয় ঘটনাই আরও বেশি করে দেখিয়ে দেয় মৃত্যুদণ্ডের আইনটা কেন এত জরুরি!’ চারদিক থেকে চাপ ছিল প্রবল। কিন্তু কমলা হ্যারিস তাঁর পথ থেকে সরেননি। শেষ পর্যন্ত ২০০৭-এ এসপিনোজার খুনিদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডই হয়। কমলা যা চেয়েছিলেন সে রকমই অর্থাৎ যেখানে প্যারোলের কোনও সুযোগ থাকবে না।

পাঁচ, ২০১২-এ ডেমোক্র্যাটদের ন্যাশনাল কনভেনশনে প্রাইম টাইম বক্তা ছিলেন কমলা হ্যারিস। সেই প্রথম গোটা দুনিয়া নড়েচড়ে বসে, জানতে চায় কে এই মহিলা। পরের বছর প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কমলাকে ‘ব্রিলিয়ান্ট’, ‘ডেডিকেটেড’ এবং ‘টাফ’ বলার পাশাপাশি একটু লঘু চালে এমনই একটি কথা বলে বসেন যার জন্য পরে তাঁকে ক্ষমাও চাইতে হয়েছিল। কমলার সম্পর্কে ওবামার সেই মন্তব্যটি ছিল, ‘বাই ফার, দ্য বেস্ট লুকিং অ্যাটর্নি জেনারেল ইন দ্য কান্ট্রি’। এ হেন কমলা হ্যারিস রোজ সকালে ব্যায়াম করেন। ২০১৬-র একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘রোজকার রুটিনে দুটি জিনিস আমাকে রাখতেই হবে। এক, ওয়ার্ক আউট। দুই, ঠিকঠাক খাওয়াদাওয়া।’ প্রথমটির মতো দ্বিতীয় বিষয়টি নিয়েও খুবই উৎসাহী কমলা। নিজে রান্না করতে ভালোবাসেন। প্রায়ই সেই সব রান্নাবান্নায় তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন স্বামী ডাগ এমহফ। যখন খুবই চাপে থাকেন রান্না করার ফুরসৎটুকুও মেলে না, তখন রিল্যাক্স করার জন্য ঠিক কী করেন কমলা হ্যারিস? বিভিন্ন রেসিপির বই পড়েন। তাতেই মনটা খানিক ঝরঝরে হয়ে ওঠে।

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ