যে গান শোনার পর আত্মহত্যা করেন ১০০র বেশি মানুষ!

পৃথিবীতে কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার তো অনেক রয়েছে। এসব সিরিয়াল কিলারদের লোমহর্ষক ঘটনা আমরা খবরে শুনেছি, পত্রিকায় বা বইতে পড়েছি। অনেক সময় এসব ঘটনা নিয়ে সিনেমাও তৈরি হয়েছে। এরকম সিরিয়াল কিলার যদি একটা গানকে বলা হয়, তাহলে বেশ আশ্চর্যই লাগবে। কিন্তু বাস্তবে এমন একটি গান সত্যিই আছে।

গানটির নাম ‘গ্লুমি সানডে’। ‘হাঙ্গেরিয়ান সুইসাইড সং’ নামেই এটি বেশি পরিচিত।

হাঙ্গেরিয়ান পিয়ানিস্ট এবং কম্পোজার রেজো সেরেস গানটির সংগীতায়োজন করেন। কবি লাজলো জাভোর লেখা এই গানটি ১৯৩৩ সালে শীট মিউজিকে (কাগতে লিখিত বা প্রিন্ট সংস্করণ) প্রকাশিত হয়। গানটির শিরোনাম ছিলো- ‘এন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড’। ১৯৩২ সালে প্যারিসে বসবাসরত অবস্থায় সেরেস এই গানটি কম্পোজ করেছিলেন। মৌলিক গানটি মেলোডি হিসেবে পিয়ানো ব্যবহার করে গাওয়া হয়েছিলো।



গানটিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বের অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে মানুষের প্রতি অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও যারা অন্যায় কাজে লিপ্ত তাদের জন্য প্রার্থনার বাণী প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪৬ সালের পূর্ব পর্যন্ত গানটির কোনো কপিরাইট সত্ত্ব ছিলো না। গানটি এতোটাই হতাশাব্যঞ্জক লিরিকের ছিলো যে, রেজো সেরেস গানটির জন্য প্রথমে কোনো প্রকাশক খুঁজে পাননি।

একজন প্রকাশক তো বলেই দিয়েছিলেন, ‘এমন নয় যে এটিই পৃথিবীর একমাত্র দুঃখের গান। কিন্তু গানটির কথায় এমন কিছু রয়েছে যা ভয়ানকভাবে হতাশাব্যঞ্জক। আমি মনে করি না গানটি শোনার পর কারো ভালো কিছু হবে, ১৯৩৩ সালে কবি লাজলো জাভোর গানটির কথা পুনরায় লেখেন। সেসময় স্ত্রীর সাথে তার বিচ্ছেদ ঘটে। অনেকের মতেই লাজলো জাভোরই গানটির মূল লেখক। তিনি তার লেখায় কোনো রাজনৈতিক অনাচারের ভাষা ব্যবহার করেননি বরং তিনি ভালোবাসার মানুষের মৃত্যু ও মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে মিলিত হওয়ার কথা লিখেছেন।

গানটির এই সংস্করণটিই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং হারানো প্রেমের প্রতীক হয়ে ওঠে। লাজলো জাভোরের লিরিকে হাঙ্গেরীয় ভাষায় গানটি রেকর্ড করেন পাল কামার, ১৯৩৫ সালে। হাঙ্গেরিতে তার গাওয়া গানটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠার সাথে সাথেই উল্লেখযোগ্যভাবে আত্মহত্যার হার বেড়ে যায়। জাভোরের সাবেক স্ত্রীও আত্মহত্যা করেন। অনেক লোক বিল্ডিং-এর ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তখন তাদের হাতে গানটির শীট মিউজিক সংস্করণ ধরা ছিলো। হাঙ্গেরীয় কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত গানটি প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

হাঙ্গেরিয়ান সুইসাইড সং-টি সংবাদমাধ্যমে প্রচার পাওয়ার পরপরই বিভিন্ন ভাষায় এটি অনুবাদ করে রেকর্ড করা হয়। ১৯৩৫ সালে পিওতর লেসচেনেকো রুশ ভাষায় গানটি প্রকাশ করেন। ১৯৩৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দামিয়া ফরাসি ভাষায় গানটি রেকর্ড করেন। জাপানি ভাষায় নরিকো আওয়ায়া কর্তৃক সে বছরই গানটি প্রকাশিত হয়। ইংরেজি ভাষায় একটু আলাদা লিরিক নিয়ে বেশ কয়েকটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় সংস্করণের কথা লেখেন স্যাম এম লুয়াইজ।

এটি প্রথম ১৯৩৬ সালে ব্যান্ডলিডার হাল ক্যাম্প, ভোকাল বব এলেন রেকর্ড করেন। গানটির লিরিকই ছিলো আত্মহত্যার জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক। ইংল্যান্ডের ডেসমন্ড কার্টার গানটির আরেকটি সংস্করণ তৈরি করেন। সেটাতে তিনি পুনরায় রেজো সেরেসের কথাকে তুলে আনেন। ১৯৩৬ সালেই গানটি পল রবসন রেকর্ড করেন।

‘স্যাডলি ওয়ান সানডে আই ওয়েটেড এন্ড ওয়েটেড…’ ‘সানডে ইজ গ্লুমি, মাই আওয়ার্স আর স্লামবারলেস…।’ ‘গ্লুমি ইজ সানডে, উইথ শ্যাডো আই স্পেন্ড ইট অল, মাই হার্ট এন্ড আই হ্যাভ ডিসাইডেড টু এন্ড ইট অল’ ইত্যাদি লিরিকের গানটি ঠিক কেন ‘সুইসাইড সং’ নামে কুখ্যাত হয়েছিলো তা এখন আর বলা যায় না নিশ্চিত করে।

তবে একটি বিষয় হলো বর্তমান সময়ে আমরা যেটিকে বলি ‘হাইপ’- সেকালেও এর নেতিবাচক প্রভাব ছিলেন। ফলে গানটির সুরকার, গীতিকার নিজেদের মানসিক অবস্থা বা নানা কারণে আত্মহত্যা করলে এবং মাত্রাতিরিক্ত হতাশায় ভোগা কিছু মানুষ গানটি শুনে আত্মহত্যা করলে মানুষের মনে এই ধারণা জন্মে যায় যে গানটি আত্মহত্যাকে প্ররোচিত করে তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে গানটির মিউজিক কম্পোজিশন, লিরিক, উপস্থাপন সবকিছুই অন্যান্য দুঃখের গান থেকে আলাদা।

‘গ্লুমি সানডে’ প্রকাশিত হওয়ার পর আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় অনেক রেডিও নেটওয়ার্ক গানটির প্রচার বন্ধ করে দেয়। বলা হয় যুক্তরাষ্ট্র ও হাঙ্গেরিতে কমপক্ষে ১৯ জন এবং সাড়া পৃথিবীতে ১০০ জনেরও বেশি মানুষ গানটি শোনার পর আত্মহত্যা করেন।

১৯৪১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত বিলি হলিডে’র গাওয়া সবচেয়ে জনপ্রিয় সংস্করণটি প্রকাশের পর আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগে গানটি যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করা হয়। বিবিসি বিলি হলিডে’র গাওয়া গানটির সম্প্রচারও বন্ধ করে দেয়। বিবিসির পাশাপাশি আরো কয়েকটি রেডিও নেটওয়ার্কে গানটির প্রচার বন্ধ করে।

গ্লুমি সানডে প্রকাশিত হওয়ার পর এর সাথে সম্পৃক্তদের মাঝে সবচেয়ে বেশি দিন বেঁচে ছিলেন রেজো সেরেস। যদিও সাবেক স্ত্রী আত্মহত্যা করেন। আর ১৯৬৮ সালে, গানটি প্রকাশের প্রায় ৩৫ বছর পর রেজো সেরেস নিজেও বুদাপেস্টের একটি ভবনের জানালা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে হাসপাতালে গলায় তার পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন।

পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন শিল্পীরা গানটি গেয়েছেন। যেমন : মেল টর্মি (১৯৫৮), এলা পেলিনেন (১৯৫৯), সারা ভুগান (১৯৬১), লোরেজ আলেক্সান্দ্রিয়া (১৯৬১), কেটি লেস্টার (১৯৬২)সহ আরো অনেকে।

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ