সময়ের সাথে হারিয়ে যাওয়া শৈশবের বিলুপ্তপ্রায় খেলাগুলো

লিখেছেন মোঃ রকিবুল হাসান

শৈশবের সময়গুলোতে আমরা বিভিন্ন ধরনের খেলা খেলে এসেছি। বিনোদনের জন্য আমরা সবাই মিলেমিশে একসাথে নানা খেলায় মেতে উঠতাম। খেলাগুলো ছিল নির্মল বিনোদনে ভরপুর। তখনকার সময়ে তো আর মোবাইলে গেম খেলার উপায় ছিল না!

আজকে আমরা শৈশবের কিছু খেলাধুলার সাথে পরিচিত হবো, যেগুলো এখন আর তেমন খেলা হয় না, অথবা কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে। বিলুপ্তপ্রায় খেলাগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সাথে সাথে, সেগুলো কীভাবে খেলতে হবে, তা-ও বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। এতে অবসরে আপনিও নির্মল বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে খেলাগুলো বেছে নিতে পারেন, অথবা ছোটদের শেখানোর মাধ্যমে তাদের নির্মল বিনোদনের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন।

গোল্লাছুট

ছেলেমেয়েরা গোল্লাছুট খেলছে, Image Source: Ekabinsha

নাম থেকেই বোঝা যায় যে, এ খেলায় গোল্লা থাকবে, যারা কি না ছুটবে। হ্যাঁ, এমনটাই। খেলায় একজন রাজা থাকবে, যিনি কি না প্রধান, আর বাকি সদস্যরা হলো ‘গোল্লা’। দুইটি দলে বিভক্ত হয়ে খেলতে হয়। উভয় দলে সমান সংখ্যক খেলোয়াড় থাকে। বড় আয়তাকার একটি জমির সমান খেলার মাঠ থাকবে। চারপাশে দাগ দেয়া থাকবে। চারপাশে দাগ টেনে সীমানা নির্ধারণ করা হয়। গোল্লা এবং রাজাকে বিপরীতপাশের দাগ পার হতে হয়। গোল্লা যখন দৌঁড়ে বিপরীত দাগ ছুঁতে যাবে, তখন দাগের বাইরে যাওয়া যাবে না। দাগের বাইরে গেলে বা গোল্লাকে ছুঁয়ে দিলে খেলা থেকে বসিয়ে রাখা হবে। আর রাজা দৌঁড়ানোর সময় ছুঁয়ে দিলে প্রথম দল পরাজিত হবে, এবং অপর পক্ষ খেলার সুযোগ পাবে।

শুরুর দিকে দাগের ভেতরে প্রথম পক্ষ নিরাপদভাবে অবস্থান করে, এবং শেষ দাগ পার হবার জন্য চেষ্টা করে। শুরুর দিকের দাগের ভেতরে থেকে অপরপক্ষের কাউকে ছুঁয়ে দিলে অপরপক্ষের ঐ খেলোয়াড়কে খেলা থেকে বসিয়ে রাখা হয়। যখন প্রথমপক্ষ পরাজিত হয়, তখন আবার খেলতে পারে। রাজা শেষ প্রান্ত অতিক্রম করলে প্রথমপক্ষ এক পয়েন্ট পাবে। আর সব গোল্লা শেষ প্রান্ত অতিক্রম করলে যতজন গোল্লা সফলভাবে অতিক্রম করেছে, সবাই শুরুর প্রান্ত থেকে একটা করে লাফ দিবে শেষ প্রান্তের দিকে। এখন শেষ প্রান্তের অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছে। এখান থেকে আবার শেষ প্রান্তের দিকে দৌড়ে যেতে হবে। যে কয়জন সফল হবে, তারা আবার লাফ দিবে শেষ প্রান্তের দিকে। শেষ প্রান্ত পেয়ে গেলে এক পয়েন্ট অর্জন করবে প্রথম পক্ষ।

কানামাছি

চোখ বেঁধে কানামাছি খেলার দৃশ্য, Image Credit: Ferdousi Begum

‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছোঁ।’ এই বিখ্যাত ছড়াটুকু আশা করি সবারই মনে আছে। ওই একজনের চোখ বেঁধে কানা সাজানো হতো, আর বাকিরা মাছির মতো ঘুরতে থাকতো। চোখ বাঁধার পর সেটা আবার সামনে আঙুল নাড়িয়ে পরীক্ষাও করে নেওয়া হতো। তারপর বারকয়েক ঘুরিয়ে ছেড়ে দেওয়া হতো। চোখ বাঁধা অবস্থায় যাকে ছুঁয়ে দেবে এবং তার নাম বলতে পারলে ওই ধৃতজনই হবে পরেরবারের জন্যে কানামাছি।

দাঁড়িয়াবান্ধা/বদন খেলা

দাড়িয়াবান্ধা খেলায় প্রতিপক্ষকে বাধা দেবার চেষ্টা করছে; Image Credit: Rajdeep Banarjee/Anandabazar

খেলার জন্য দরকার উন্মুক্ত জায়গা। এটাও বেশ জনপ্রিয় খেলা ছিল বৈকি। দুটো দলে ভাগ হয়ে খেলতে হয়, যেখানে প্রতি দলে সচরাচর চার থেকে ছয়জন সদস্য প্রয়োজন পড়ে। এই খেলায় প্রথমে কাঠি/কঞ্চি দিয়ে অনেকটা ব্যাডমিন্টন কোর্টের আদলে আটটি ঘর টেনে নেওয়া হয়। এক ঘর থেকে আর এক ঘরে যাওয়ার সময়ে অন্য দলের বাধা অতিক্রম করতে হয়। ঘর পরিবর্তনের সময়ে প্রতিপক্ষের কেউ পা দিয়ে ছুঁয়ে দিলে সে খেলার বাহিরে বসে থাকবে। এভাবে শেষে দলনেতাকেও ছুঁয়ে দিলে অন্য দল খেলার সুযোগ পাবে। শীতকালে দাঁড়িয়াবান্ধা খেলার জমজমাট আড্ডা হতো একসময়।

গোলাপ-টগর খেলা

প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়ের কপালে টোকা দিচ্ছে, Image Source: AllGamesRules Blogspot Website

খেলায় দুটো দল থাকতো। আর দুই দলেরই একজন করে দলনেতা থাকতো, যারা ঠিক করতো তারা কোন বিষয় নিয়ে নামকরণ করবে। হয়তো এক দল ঠিক করল, তারা ফুলের নাম নেবে, আর এক দল ঠিক করল তারা ফলের নাম নেবে। তারপর দুই দল দু’দিকে চলে গিয়ে ঠিক করতো, দলের কার কী নাম। নাম করা হয়ে গেলে দু’দলের সদস্যরা দু’দিকে লাইন করে বসতো। ফুলের দলের দলনেতা ফলের দলে গিয়ে ঐ দলের কারোর চোখ বন্ধ করে নিজের দলের কারোর নাম ধরে ডাকতো, “আয় তো আমার টগর”। টগর যার নাম হবে, সে গিয়ে যার চোখ বন্ধ করা আছে, তার মাথায় টোকা মেরে নিজের জায়গায় এসে পেছন ফিরে বসবে। তার সঙ্গে ফুলের দলের বাকিরাও পেছন ফিরে বসবে। এবার যার চোখ বন্ধ করা হয়েছিল,সে আসবে ফুলের দলের কাছে, এবং খুঁজে বের করবে কে মাথায় টোকা দিয়ে এসেছে। এইভাবেই চলতে থাকবে।

কাঠিছোঁয়া খেলা

চক দিয়ে ছোট একটা গোল করতে হয়। গোলের মধ্যে অনেকগুলো ম্যাচের কাঠি একসাথে নিয়ে ফেলে দেয়া হতো। অন্য কোনো কাঠি না নড়িয়ে একটা একটা করে কাঠি গোলের বাইরে আনতে হতো। অন্য কাঠি নড়ে গেলে বা কাঠি দাগের ওপর পড়লে আউট হয়ে যেত। এই খেলাটাকে ‘কাঠি-কাঠি’ ও বলা হত।

লুকোচুরি

সবাই লুকিয়ে পড়ছে, Image Credit: FlairImages/istockphoto

প্রথমে দশ, বিশ, ত্রিশ এভাবে একশ’ পর্যন্ত গণনা করা হতো। যার কাছে এসে একশ’ বলা হতো, সে উঠে অন্যত্র সরে দাঁড়াবে। শেষে যে পড়ে থাকবে, সে হবে এই খেলার চোর। যে চোখ বন্ধ করে উল্টো গণনা করে, আর সেই সময়ের মধ্যে বাকিরা বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে পড়ে। যে চোর হয়, তার কাজ বাকিদের খুঁজে বের করা। খেলার সবচেয়ে মজার অংশটি হল ধাপ্পা দেওয়া। এর অর্থ, খুঁজতে আসা চোরকে পেছন থেকে ধরে ফেলা। তখন আবার নতুন করে উল্টো গণনা করতে হতো এবং সবাই আবার লুকিয়ে পড়তো। এভাবেই খেলা চলতে থাকতো। এখনও খেলাটির কিয়ৎ প্রচলন থাকলেও সেই জনপ্রিয়তা আর নেই।

কুমিরডাঙা

কুমিরডাঙা; Image Source: Sachalayatan

প্রথমে লটারি করে যে চোর নির্ধারণ হবে, সে হবে কুমির। কুমিরকে জিজ্ঞাসা করা হবে, জল নেবে নাকি ডাঙা। কুমির কোনো একটি বেছে নিলে সেই হিসেবে বাকিরা চেষ্টা করে কুমিরের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার জন্য। যদি কুমির ডাঙা নেয়, সেক্ষেত্রে বাকিরা জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করে। আর যদি কুমির জল নেয়, তবে সেক্ষেত্রে ঘটবে ঠিক উল্টোটা। কুমির যাকে ছুঁয়ে দেবে, সে হবে পরবর্তী কুমির।

ডাঙ্গুলি

ডাংগুলি; Image Credit: Vengat Siva

একটি এক-দেড়হাত পরিমাণ লাঠি এবং একটি ছোট লাঠির টুকরা লাগবে। একটা গর্তে ছোট লাঠির টুকরোটা রেখে বড় লাঠি দিয়ে অনেক দূরে ছুঁড়ে মারা হতো। এরপর দূর থেকে ঢিল মেরে বড় লাঠিটি লাগাতে হত। বড় লাঠি গর্তের উপর রাখা থাকে। বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছোট লাঠির টুকরা ছুঁড়ে মারা হয়।

এক্কা-দোক্কা খেলা

এক্কাদোক্কা খেলার ঘর, Image Credit: Md. Rakibul Hasan

এক্কাদোক্কা খেলাটি গ্রামে ‘কুতকুত খেলা’ নামেও বহুল পরিচিত। ছোটবেলায় এই খেলাটি কমবেশি সবাই খেলে। বাড়ির উঠোন, ঘরের ছাদ বা যেকোনো খোলা জায়গায় এটি খেলা যায়। এই খেলাটি খেলার জন্য প্রথমে আয়তাকার আকৃতির দুইটি ও বর্গাকৃতির একটি ঘর করতে হয়। বর্গাকৃতির ঘর কোণাকুণিভাবে দাগ টেনে চারভাগ করা হয়। কমপক্ষে দুইজন খেলোয়াড় প্রয়োজন হয়, তবে একাও খেলা যায়।

মাটির হাঁড়ির ভাঙা টুকরা বা এমন কিছু যা এক পায়ে টোকা দিয়ে সরানো যাবে, এই উপকরণটিকে ‘চাড়া’ বলা হয়। এবার একজন চাড়াটি প্রথম ঘরে ফেলে এক পায়ে দাঁড়িয়ে পায়ের আঙুল দিয়ে টোকা দেয়ার সময় ‘কুত কুত’ বলতে বলতে একটি করে ঘর অতিক্রম করবে। সবগুলো ঘর ঘুরে চাড়াটি দাগের বাইরে নিয়ে আসতে হবে। এরপর দ্বিতীয় ঘরে চাড়া ফেলে চাড়াটি টোকা দিয়ে সবগুলো ঘর অতিক্রম করতে হবে। এভাবে একটি একটি করে সবগুলো ঘরে চাড়া ফেলতে হয়। যে নিয়ম মেনে সবগুলো ঘরে চাড়া ফেলে সবার আগে অভিযান সম্পন্ন করবে, সে-ই জয়ী হবে। এই প্রক্রিয়ার কোথাও চারা বা পায়ের কোনো অংশ ঘরগুলোর দাগে স্পর্শ করলে, টোকা দেয়ার সময় একটি ঘর বাদ রেখে অন্য ঘরে চারা চলে গেলে, কিংবা দম ফুরিয়ে গেলে, তখন অন্য খেলোয়াড় খেলার সুযোগ পাবে। স্থানভেদে ঘর কমবেশি বা ভিন্নরকম করে আঁকানো হয়, কিন্তু খেলার অন্যান্য নিয়ম প্রায় একই।

স্যান্ডেল চোর

সবার স্যান্ডেলগুলো সরলরেখার মতো করে রাখতে হয়। অপরপাশে আরেকটা দাগের ভেতর থেকে দম নিয়ে শব্দ করতে করতে স্যান্ডেলগুলোর কাছে আসবে। প্রতিপক্ষ খেলোয়াড় এই স্যান্ডেলগুলো পাহাড়া দেবে। দম থাকতে জুতার সমান্তরাল রেখার বাইরে থেকে ভেতরে থাকা প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে ছুঁয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়। এরপর যেই না স্যান্ডেল নিয়ে যেতে থাকে, তখন প্রতিপক্ষ খেলোয়াড় চোরকে ছুঁয়ে দেয়।  নিজেদের দাগের ভেতর স্যান্ডেল নিয়ে সফলভাবে চুরি করা সম্ভব হলে এক পয়েন্ট অর্জিত হয়।

চারগুটি

শোলা এক আঙুল পরিমাণ কেটে দুই ভাগ করতে হয়। এরকম চারটা টুকরা প্রয়োজন হয় এই খেলায়। চারটা অর্ধ টুকরা বা গুটি হাতের মধ্যে নিয়ে উপর থেকে ফেলতে হয়। চারটা গুটির সমান্তরাল পার্শই উপর দিক হয়ে পড়লে একেকটা গুটি ধরতে পারলে চার পয়েন্ট পাবে। যে ফেলে সে ছাড়া অন্যরা এতে কাড়াকাড়ি করে ধরা চেষ্টা করে। আর যদি চারটায় টেঊ পাশেরটা পড়ে তাহলে যে গুটিগুলো ফেলেছে সে চার পয়েন্ট পাবে এবং খেলা শুরু হয়ে যাবে। টোকা দেবার সময় একটা গুটি দিয়ে একটা গুটিই টোকা দেয়া যাবে। একের অধিক গুটি ছোঁয়া লাগলেই প্রতিপক্ষ খেলোয়াড় খেলার সুযোগ পাবে। একটা নির্দিষ্ট পয়েন্টের টার্গেটে যে পৌঁছাবে, সে জয়ী হবে।

মার্বেল খেলা বা গুটি খেলা

মার্বেল বা গুটি খেলার দৃশ্য; Image Credit: Chobiwala 

মার্বেল হল কাঁচের বা প্লাস্টিকের তৈরি ছোট ছোট বল। গ্রাম বাংলার ছেলে-মেয়েরা এই কাঁচের মার্বেল দিয়ে নানা ধরনের খেলা খেলত। খেলার মূল ধারণাটি ছিল আঙুলের সাহায্যে একটি মার্বেল দিয়ে অপর একটি লক্ষ্য মার্বেলকে আঘাত করা। আরেকটি নিয়ম ছিল দুইটি দাগ টানা হত। দুইটি দাগের বাইরে পা রেখে বসে থেকে অন্য দাগের বাইরে গুটি চালা হতো। এরপর একটা গুটি দিয়ে অনেকগুলো গুটির মাঝে শুধু একটি গুটিকেই লাগাতে হবে। যদি একের অধিক গুটিতে স্পর্শ লাগে, তাহলে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়রা খেলার সুযোগ পাবে। আর একটি গুটিতে লাগলে নির্দিষ্ট সংখ্যক গুটি যে চালবে, তাকে দিতে হতো। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে খেলাটির নানা ধরনের নিয়ম আছে এবং খেলোয়াড়রাও নিজেদের কিছু শর্ত বা নিয়ম তৈরি করে।

দেশলাই ও সিগারেটের বাক্স দিয়ে খোলা খেলা

সিগারেটের বাক্সকে দুইভাগ করা হত। প্রতিটা আলাদা ব্রান্ডের সিগারেটের জন্য আলাদা ধরনের দাম নির্ধারণ করা হত। কাঁচের বা মাটির হাড়ির ভাঙা টুকরা দিয়ে খেলা হত। কারো খোলা বা ভাঙা টুকরা সেটা হাত দিয়ে দূরে ফেলা হতো, এবং বলা হতো এতগুলো এত টাকা দেবো। কারো খোলাকে দূর থেকে ছুড়ে স্পর্শ করতে পারলে সে ঐ পরিমাণ টাকা পেতো। এই টাকা সিগারেটের বাক্সের কারেন্সিতে পরিশোধ করা হত।

লাটিম খেলা

লাটিম; Image Credit: Fahim Islam/Flickr

লাটিম বাংলাদেশের অন্যতম একটি গ্রামীন খেলা। আগে সুতার মিস্ত্রিরাই গ্রামের কিশোরদেরকে লাটিম বানিয়ে দিত। তারা সাধারণত পেয়ারা ও গাব গাছের ডাল দিয়ে এই লাটিম তৈরি করতো। এতে লাটিম অনেক শক্ত হয়। নির্বাচিত পাট থেকে লাটিমের জন্য লতি বা ফিতা বানানো হতো। বর্তমানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তুলাজাতীয় নরম কাঠ দিয়ে লাটিম এবং গেঞ্জির কাপড় দিয়ে লাটিমের ফিতা বানানো হয়।

ষোল গুটি ও বাঘ বকরি খেলা

দুইটি খেলার ঘর আঁকানোর নিয়ম একই। দুই পাশে ১৬টি করে গুটি সাজানো থাকে। একটি গুটি সামনে পেছনে বামে ডানের নিকটতম বিন্দুতেই শুধুমাত্র চাল দেওয়া যায়। অপরপক্ষের গুটি থাকলে চাল দেয়া যায় না। তবে অপরপক্ষের গুটি একটি সরলরেখার দ্বিতীয় বিন্দুতে, নিজের গুটি প্রথম বিন্দুতে ও তৃতীয় বিন্দু ফাঁকা থাকলে আপনার গুটি তৃতীয় বিন্দুতে রাখতে পারবেন। এই নিয়মে এক বা একাধিক গুটি খাওয়া যায়। এ খেলায় অপরপক্ষের গুটি সবগুলো খেতে পারলে, আপনি জয়ী হবে।

এ তো গেল ষোল গুটির কথা। বাঘ-বকরি বা বাঘবন্দী খেলায় একটিমাত্র গুটি থাকে, যাকে বাঘ বলে। এই বাঘকে ছাগল খেতে পারে না। একে আটকানোর চেষ্টা করা হয়, যেন কোনোদিক গুটি সরাতে না পারে। আরেকপক্ষে ১৬টি ছাগল, তথা গুটিগুলো ষোলগুটির নিয়মেই সাজানো থাকে। ঐ একই নিয়ম, বাঘ-বকরি খেলার ঘরের মধ্যে যে বিন্দুগুলো থাকে, গুটিগুলো ঐ বিন্দুগুলো দিয়েই নড়াচড়া করবে। ধরা যাক একটি সরল রেখার তিনটি বিন্দুর মাঝে প্রথম বিন্দুতে কোনো গুটি নেই, দ্বিতীয় বিন্দুতে ছাগলের গুটি আর তৃতীয় বিন্দুতে বাঘের গুটি রয়েছে। এক্ষেত্রে বাঘের চাল দেয়ার সময় হলে বাঘ তৃতীয় বিন্দু থেকে গুটি সরিয়ে প্রথম বিন্দুতে রাখবে এবং ছাগলকে ঘরের বাইরে রেখে দেবে, যাকে ‘গুটি খেয়ে দেয়া’ বলে। এভাবে গুটি সবগুলো খেলে বাঘপক্ষ জিতবে। আবার বাঘের চাল দেয়া আটকাতে পারলে ছাগলপক্ষ জিতে যাবে।

বালিশ খেলা

গোল হয়ে বসতে হয়। একজন না দেখে একটু পরপর বাঁশি দিবে। বাঁশি দিলে যার কাছে বালিশ থাকবে, সে বাদ পড়বে। এভাবে শেষজন যিনি হবেন সে খেলার জয়ী।

রুমালচোর

চোরকে উল্টোদিক হয়ে থাকতে হয়, আর অন্যরা গোল হয়ে বসে থাকে। এ সময় চোরের অজ্ঞাতে একজনের কাছে গোপনে রুমাল রাখা হয়। রুমাল রাখা হলে সবার দিকে পাশ ফিরতে হয়। এবার চোরের কাজ হলো, যার কাছে রুমাল রাখা আছে, নির্ভুলভাবে তার নাম বলা। যদি ভুল হয়, তাকে আবার চোর সাজতে হয় আগের মতো করে।

ঘুড়ি উড়ানো

আকাশে ঘুড়ি উড়ানোর প্রচলনটা সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে যাচ্ছে। এখন খুব কমই ঘুড়ি উড়ানো দেখতে পাওয়া যায়।

কাবাডি

ঐতিহ্যবাহী কাবাডি খেলা, Image Credit: Sukumaran Sundar

কাবাডি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী খেলা। কাবাডি খেলাটি বাংলাদেশে ‘হাডুডু’ নামেও পরিচিত। জমজমাট আসর বসতো এই খেলাকে কেন্দ্র করে। প্রতিযোগিতার আয়োজনও হতো। এই খেলার প্রচলন এখন নেই বললেই চলে।

ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা

এই খেলায় একজন চোর হবে। অন্যরা আশেপাশেই ঘুরঘুর করবে। দম নিয়ে একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে দৌঁড়ে চোর যাকে ছুঁয়ে দেবে, পরবর্তীতে সে-ই হবে চোর। দম নিয়ে আবার সেই নির্দিষ্ট স্থানে ফেরত আসতে হবে চোরকে। চোরের দম ফুরিয়ে গেলে, ঘরে বা নির্দিষ্ট স্থানে প্রবেশ করার আগে অন্য কেউ চোরকে ছুঁয়ে দিলে সে আবার চোর হবে।

পাঁচগুটি/কড়ি খেলা

পাঁচটি পাথর দিয়ে পাঁচগুটি; Image Source: Inshaschool

পাঁচটা কড়ি পাথর দিয়ে হাতের নানান কসরতে পাঁচগুটি খেলা হত। হাতের কড়ে কখনো একটা গুটি রেখে বাকি চারটা উপর ছুঁড়ে দিয়ে ধরতে হয়, নিচে পড়ে গেলে প্রতিপক্ষ খেলার সুযোগ পায়।

টাগ অফ ওয়ার

দুই দলের মাঝখানে একটি দাগ দিতে হয়। একটি লম্বা ও শক্ত দড়ি লাগবে। এরপর দুই দল দড়ি ধরে টানাটানি করবে। যে দল নিজের দিকে দড়ি টেনে নিয়ে আসবে এবং অপরপক্ষকে দাগ অতিক্রম করতে বাধ্য করবে, তখন প্রথম পক্ষ খেলায় জিতে যাবে।

দড়ি টানাটানি, কিংবা টাগ অফ ওয়ার; Image Credit: ShutterStock/wavebreakmedia

টায়ার দৌড়ানো

টায়ার ঘোরাতে ঘোরাতে দৌড়ানো, Image Source: https://nagorikbarta.com/news-details/12215

মার্বেল খেলার মতো নিষেধাজ্ঞায় জড়ানো একটি মজার খেলা টায়ার দৌঁড়ানো। রিক্সা, ভ্যান কিংবা ছোট তিন চাকার যানের চাকাগুলো নিয়ে অনেকেই গ্রামের পথে-ঘাটে দৌঁড়ে বেড়িয়েছেন শৈশবে। অবশ্য এর জন্য প্রচুর বকাঝকাও শোনতে হয়েছে।

লাঠি খেলা

লাঠি খেলার মনোরম মূহুর্ত, Image Source: Rupak Aich/Magurabarta

লাঠি খেলার প্রচলন এখনো আছে। কিন্তু এই খেলা শেখার আগ্রহ তরুণদের মাঝে কমে যাচ্ছে। যার কারণে পুরনো খেলোয়াড়রা বয়স্ক হয়ে পড়লে খেলোয়াড় সংকট দেখা দেয় এবং আগের মতো খেলা দেখায় আর মজা পাওয়া যায় না। লাঠি দিয়ে আরেকজনকে মারতে হয়, আর সেই খেলোয়াড় লাঠি দিয়ে আঘাত পাওয়া থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা করে। তারপরও দুই-একটা লাঠির আঘাত খেতেই হয়।

মোরগ লড়াই; Image Source: Ajker Patrika

মোরগের লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই, বর্ষাকালে নৌকাবাইচ, গ্রীষ্মকালে ঘোড়দৌড়, গরুর গাড়ির দৌঁড় – এই খেলাগুলোর প্রচলনও আস্তে আস্তে আমাদের মাঝে থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এখানে উল্লেখিত কিংবা অনুল্লেখিত নাম না জানা আরো অনেক খেলাই রয়েছে, যা আমাদেরকে নির্মল বিনোদন দেয়। শুধু বিনোদনই নয়, শৈশবে এই খেলাগুলোর মাধ্যমে মানসিক বিকাশ হওয়ার পাশাপাশি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষতাও বৃদ্ধি পেতে সহায়তা করে। আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের সঞ্চালনা হওয়ায় সেগুলোর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

শৈশবের এই খেলাগুলো বাচিয়ে রাখা আমাদেরই দায়িত্ব। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে খেলাগুলো শিখানোর মাধ্যমে আমরা এই নির্ভেজাল আনন্দের খেলাগুলো হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে পারি।

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ