কোভিড-১৯ ড্রাগ ও চিকিৎসাঃ বর্তমান প্রেক্ষাপট

লিখেছেন ড: মোহম্মদ মাহবুব চৌধুরী

কোভিড-১৯ মহামারিতে গো্টাবিশ্ব স্মরনকালের এক ভয়াবহ সময় অতিক্রম করছে- গত পাঁচ মাসে সারা বিশ্বে ৫, ৪০৪, ৬৪৮ জন লোক আক্রান্ত হয়েছে এবং ৩৪৩,৯৮২ জন লোক মৃত্যুবরন করেছে। মানুষ আতঙ্কগ্রস্থ কারন এই ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে ও দ্রুত-বিস্তারকারী রোগটি ‘প্রাণঘাতী’ এবং এমুহূর্তে রোগটির প্রতিরোধকারী কোন ভ্যাক্সিন বা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার জন্য কোন কার্যকরী ড্রাগ বা থেরাপি মানুষের হাতে নেই! করোনা রোগীর টেস্ট ও ‘বিশেষায়িত’ চিকিৎসা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থব্যবস্থা বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই পর্যাপ্ত নয়-অনেক উন্নত দেশের স্বাস্থব্যবস্থাও ক্রমবর্ধমান রোগীর চাপে প্রায় বিপর্যস্ত! উপরন্তু রোগটির বিস্তার রোধে গতকয়েক মাসের সামাজিক দুরত্ব ও লক-ডাউনের নীতি বাস্তবায়নের ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিও এক মারাত্মক হুমকির সন্মুখীন! তাই শীঘ্রই রোগটির একটি কার্যকরী মেডিকেল সমাধান খুজে পাওয়া খুবই জরুরী।

কোভিড-১৯ এর প্রচলিত চিকিৎসা:

করোনা ভাইরাস মানুষের ফুসফুসের কোষকে সরাসরি আক্রমন করে কোষের ভিতরে দ্রুত বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে মারাত্মক ইনফেকশন (Infection) সৃষ্টি করে। সাধারনত রোগের উপসর্গ প্রকাশিত হলে বাসায় পর্যাপ্ত বিশ্রাম, ঠান্ডা-কাশি-জ্বরের ওষুধ গ্রহন এবং প্রচুর ফ্লুইড (পানি, জ্যুস) পান করাই হল রোগটির ‘সাধারন’ চিকিৎসা। মোটামুটি ৮০ ভাগ ক্ষেত্রেই কোন বিশেষায়িত চিকিৎসা ছাড়াই রোগী ১০-১৫ দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠে। তবে প্রচন্ড শ্বাস-কষ্ট শুরু হলে হাসপাতালের আইসিইউতে ভেন্টিলেটর এর মাধ্যমে কৃত্রিম উপায়ে রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করতে হয়। এই  অবস্থায় শরীরের ইমিউন সিষ্টেম ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভাল প্রতিরোধ গড়ে তুললে ১৫-২০ দিনের মধ্যেই রোগী সুস্থ হয়ে উঠে। কিন্তু রোগীর ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্ট, রক্তচাপ বা কোন কারনে ইমিউন সিষ্টেম দুর্বল হলে এই ইনফেকশনটি মারাত্মক হয়ে প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া বা হার্ট অ্যাটাকে রোগী মারা যায়।

কোভিড-১৯ মোকাবিলার মেডিকেল সমাধান মুলত দুটি:

১) ভ্যাকসিন বা টীকা (Vaccines): এটি মুলত রোগটির প্রতিরোধমুলক ব্যবস্থা যাতে কোন সুস্থ ব্যক্তিকে আগে থেকেই একটি কার্যকরী ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে তার ইমিউন সিষ্টেমকে প্রস্তুত করা হয় যাতে সত্যিকারের ভাইরাস আক্রমনে নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি তৈরীর মাধ্যমে ফুসফুস কোষকে রক্ষা করতে সমর্থ হয়।

২) ড্রাগ বা থেরাপি (Drug or Therapy): এটি মুলত কোভিড-১৯ রোগীর জন্য একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা (প্রতিক্রিয়ামুলক) যাতে রোগীর উপর কোন কার্যকরী ড্রাগ প্রয়োগ করে ফুসফুস কোষে ভাইরাসটির প্রবেশ বা বংশবিস্তারকে বাধাগ্রস্থ করে ভাইরাসজনিত ইনফেকশন এবং রোগের প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট মারাত্মক ইনফ্লেমেশনকে প্রতিহত করা যায়।

এখন কোভিড-১৯ এর একটি কার্যকরী ভ্যাকসিন আবিষ্কার, ট্রায়াল, উৎপাদন ও অনুমোদন প্রক্রিয়াশেষে মানুষের কাছে পৌছাতে ন্যুনতম ১২-১৮ মাস সময় লাগবে বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন। তাই এই সময়ের মধ্যে কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসার জন্য একটি কার্যকরী ড্রাগ/থেরাপি খুজে পাওয়া জরুরী যার উদ্দেশ্য প্রধানত: আক্রান্ত রোগীকে বাঁচানো, ‘বিশেষায়িত’ চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করে স্বাস্থ্যব্যবস্থার উপর অতিরিক্ত চাপ কমানো এবং সর্বোপরি, লক-ডাউন তুলে নেবার অত্যানুকুল পরিবেশ সৃষ্টি করে স্থবির হয়ে পড়া বিশ্ব-অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করন।

কোভিড-১৯ ড্রাগ নির্বাচন স্ট্রাটেজিঃ

কোভিড-১৯ সংক্রমণকারী করোনা ভাইরাসটি নতুন বিধায় রোগটির চিকিৎসার জন্য নতুন কোন ড্রাগ আবিষ্কার করা সময়সাপেক্ষ। তাই আপাতত রোগটির চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞরা মুলত অন্যান্য ভাইরাসজনিত রোগে ব্যবহৃত প্রচলিত কিছু ড্রাগ বা থেরাপিকেই ‘বিবেচনা’ করছেন। মুলত তিন ধরনের ড্রাগ/থেরাপিকে টার্গেট করা হয়েছে:

১) অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ (Anti-Viral Drug) : যার লক্ষ্য হচ্ছে সরাসরি ভাইরাসের সক্রিয়তা বা বংশবিস্তারকে বাধাগ্রস্থ করে ভাইরাসজনিত ইনফেকশন বন্ধ করা বা হ্রাস করা।

২)  অ্যান্টিবডি থেরাপি (Antibody Therapy): যার লক্ষ্য হচ্ছে কোন সদ্য-সুস্থ রোগীর দেহ হতে নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি সমৃদ্ধ রক্তের প্লাজমা বা আলাদাভাবে প্রস্তুতকৃত অ্যান্টিবডি-ড্রাগ আক্রান্ত রোগীর শরীরে প্রয়োগ করা যাতে অ্যান্টিবডিগুলো ভাইরাসের ক্ষতিকর অংশের (অ্যান্টিজেন) সাথে যুক্ত হয়ে ভাইরাসজনিত ইনফেকশনকে প্রতিরোধ করতে পারে।

৩)  ইমিউন সিষ্টেম রিলাক্সিং ড্রাগ (Immune System Relaxing Drug) : যার লক্ষ্য হচ্ছে মুলত রোগের বিভিন্ন পর্যায়ে ইমিউন সিষ্টেমের ‘অতি-সক্রিয়তা’ জনিত মারাত্মক ইনফ্লেমেশন হতে রোগীকে রক্ষা করা। ‘অ্যান্টিভাইরাল’ ড্রাগের সাথে এদের ‘সমন্বিত-ড্রাগ’ এর কার্যকারিতাও যাচাই করা হবে।

কোভিড-১৯ চিকিৎসায় ‘সম্ভাবনাময়’ ড্রাগ:

বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রায় ১৫০টিরও বেশী সম্ভাব্য ড্রাগ নিয়ে গবেষনা চলছে যার মধ্যে নিম্নোক্ত ড্রাগগুলো এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ‘সম্ভাবনাময়’ ড্রাগ হিসেবে বিবেচিত হয়েছেঃ

১) রেমডেসিভির (Remdesivir_Gilead Sciences Inc.): যুক্তরাষ্ট্রের ‘জিলেড’ কোম্পানীর প্রস্তুতকৃত এই পরীক্ষামুলক ‘অ্যান্টিভাইরাল’ ড্রাগটি এমুহুর্তে সবচেয়ে বেশী আলোচিত। ড্রাগটি করোনা ভাইরাসের আরএনএ (RNA) কে টার্গেট করে ভাইরাসের বংশবৃদ্ধিকে বন্ধ করতে সমর্থ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। NIAID গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালীর ১০৬৩ জন রোগীর উপর পরিচালিত ট্রায়ালের প্রাথমিক ফলাফল ঘোষনা করে জানিয়েছে যে ড্রাগটি গ্রহনকারী রোগী প্লাসিবো (ডামি ডোজ) গ্রহনকারী রোগীর তুলনায় ৪ দিন আগে আরোগ্যলাভ করেছে। FDA ইতিমধ্যে হাসপাতালে অবস্থানকারী কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসায় ড্রাগটি ব্যবহার করার একটি ‘জরুরী অনুমোদন’ও প্রদান করেছে। কিন্ত একই সময়ে চীনে ২৭৩ জন রোগীর উপরে পরিচালিত ট্রায়ালে আরোগ্য লাভের সময়, শরীরে ভাইরাসের পরিমান হ্রাস বা মৃতের সংখ্যা হ্রাসজনিত কোন সাফল্য চোখে পড়েনি- বরং ড্রাগটির কিছু ‘পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া’ উল্লেখিত হয়েছে। তাই যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের অন্যান্যদেশ, WHO আরও ব্যাপক ট্রায়ালভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষন করতে চাইছে। বর্তমানে WHO পরিচালিত আন্তর্জাতিক ‘সলিডারিটি’ ট্রায়ালে ড্রাগটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যার ফলাফল আগামি কয়েকমাসের মধ্যেই প্রকাশিত হবে।

২) ক্লোরকুইন/হাইড্রোক্সিক্লোরকুইন (Chloroquine/Hydroxychloroquine_ Teva, Sanofi, Mylan NV, Natco Pharma Ltd., Novartis AG, Bayer AG and Others): এই ম্যালেরিয়া ড্রাগদুটির ‘অ্যান্টিভাইরাল’ ও ‘ইমিউন সিষ্টেম রিলাক্সিং’-দুই ধরনের বৈশিষ্ট্যই রয়েছে যা করোনা ভাইরাসজনিত ইনফেকশন এবং পরোক্ষ ইনফ্লেমেশন প্রতিরোধে কার্যকরী ভুমিকা রাখতে পারে।

কোভিড-১৯ চিকিৎসায় ‘হাইড্রোক্সিক্লোরকুইন’ বিশেষ আলোচনায় এসেছে গত মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এর জোর প্রচারনার প্রেক্ষিতে। ঐ সময়ে চীন ও ফ্রান্সে কোভিড-১৯ জনিত নিউমোনিয়া চিকিৎসায় ‘ক্লোরকুইন’ ড্রাগটির ব্যবহারে কিছুটা সুফল পাওয়া গিয়েছিল। সাম্প্রতিক এক গবেষণার ফলাফলে দেখা গিয়েছে যে ড্রাগগুলো ভাইরাসের আক্রমন হতে অক্সিজেনবহনকারী রক্তের হিমোগ্লোবিনকেও রক্ষা করতে সক্ষম। কিন্তু ড্রাগদুটোর বড় সীমাবদ্ধতা হল ‘পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া’- যদিও ‘হাইড্রোক্সিক্লোরকুইন’ এর ‘পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া’ তুলনামুলকভাবে কম। তাই  NIAID এবং WHO- দুটি সংস্থাই মারাত্মক ‘পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া’র শংকা ব্যক্ত করে কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসায় ড্রাগদুটোর ব্যবহারে চরম সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেছে। বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রায় ১০০টিরও বেশী ট্রায়ালে ‘হাইড্রোক্সিক্লোরকুইন’ এর কার্যকারিতা যাচাই করা হচ্ছে যার প্রাথমিক ফলাফল এই মে মাসের মধ্যেই প্রকাশিত হবে। যুক্তরাষ্ট্রে ‘হাইড্রোক্সিক্লোরকুইন’ ও অ্যান্টিবায়োটিক ‘অ্যাজিথ্রোমাইসিন’ সমন্বিত-ড্রাগ এর কার্যকারিতাও পরীক্ষা চলছে। এছাড়া WHO পরিচালিত  ‘সলিডারিটি’ ট্রায়ালে ‘ক্লোরকুইন’/’হাইড্রোক্সিক্লোরকুইন’ এবং যুক্তরাজ্যে পরিচালিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ ‘রিকভারি ট্রায়াল’ এ ‘হাইড্রোক্সিক্লোরকুইন’ ড্রাগটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। একটা সামগ্রিক ফলাফল আগামি কয়েক মাসের মধ্যে পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

৩) লোপিনাভির-রিটোনাভির (Lopinavir-Ritonavir or ‘Kaletra’): এই ‘অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল’ (Antiretroviral) HIV ড্রাগদুটিও কোভিড-১৯ চিকিৎসায় ‘সম্ভাবনাময়’ ড্রাগ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, মুলত ল্যাবরেটরিতেপ্রাপ্ত প্রাথমিক ফলাফলের ভিত্তিতে। কিন্তু চীনে গত মার্চে ১৯৯ জন সংকটাপন্ন রোগীর উপর পরিচালিত সীমিত ট্রায়ালের ফলাফলে রোগীর আরোগ্য লাভের সময়, মৃতের সংখ্যা বা রোগীদেহে ভাইরাসের পরিমান হ্রাসের কোন প্রমান পাওয়া যায়নি- সম্ভবত অধিকাংশ রোগীরই অন্তিম মুহূর্তে ড্রাগদুটো প্রয়োগ করার কারনে। তাই ইনফেকশনের শুরুর দিকে একটি বৃহৎ ট্রায়ালের মাধ্যমে ড্রাগদুটোর কার্যকারিতা পরীক্ষা করার সুপারিশ করা হয়েছে।

WHO পরিচালিত ‘সলিডারিটি’ ট্রায়াল এবং যুক্তরাজ্যের ‘রিকভারি’ ট্রায়াল এ ড্রাগদুটো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। WHO’ পরিচালিত ট্রায়ালে এইদুটি ড্রাগ এবং ‘ইন্টারফেরন বেটা’ (Interferon beta-1a, একটি ইমিউন সিস্টেম রিলাক্সিং ড্রাগ)’ সমন্বিত- ড্রাগের কার্যকারিতাও পরীক্ষা করা হচ্ছে।

৪) ফ্যাভিপিরাভির (Favipiravir or ‘Avigan’_ Fujifilm Holding Corp.): জাপানের ‘ফুজিফিল্ম’ এর এই অ্যান্টিভাইরাল ‘ফ্লু’ ড্রাগটি করোনা ভাইরাস ইনফেকশনের  প্রাথমিক পর্যায়ে কার্যকরী ভুমিকা রাখবে বলে বিশেষজ্ঞরা মতপ্রকাশ করেছেন। গত মার্চে চীনে ৮০ জন কোভিড-১৯ রোগীর উপর পরিচালিত একটি সীমিত ট্রায়ালের ফলাফলে এই ড্রাগটির ব্যবহারে HIV ড্রাগ এর চেয়ে এক সপ্তাহ কম সময়ে রোগীর আরোগ্য লাভ হয়েছে বলে দাবী করা হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষনায় ড্রাগটির মারাত্মক কিছু ‘পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া’র কথাও উঠে এসেছে। চীন, জাপান ও ইতালিতে ইতিমধ্যেই শুরু হওয়া হিউম্যান ট্রায়ালের ফলাফল আগামি কয়েক মাসের মধ্যেই প্রকাশিত হবে।

৫) কনভালেসেন্ট ব্লাড-প্লাজমা ( Convalescent plasma, TAK-888_Takeda Pharma): এটি একটি অ্যান্টিবডি ভিত্তিক থেরাপি। এই মুহূর্তে জাপানের ‘তাকেদা ফার্মা’ সুস্থ হয়ে উঠা কোভিড-১৯ রোগীর শরীরে উৎপন্ন অ্যান্টিবডি সমৃদ্ধ রক্তের প্লাজমা সংগ্রহ করে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় ব্যবহার করার প্রস্তুতি নিচ্ছে । এই অ্যান্টিবডিগুলো করোনা ভাইরাসের ‘স্পাইক’ প্রোটিনের সাথে যুক্ত হয়ে ইনফেকশনকে প্রতিহত করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। ‘তাকেদা’ জানিয়েছে এবছরের শেষ নাগাদ এই ‘প্লাজমা-থেরাপি’র অনুমোদন পাওয়া যাবে, তবে এর মাঝে কার্যকরী-ডোজ নিশ্চিত করার জন্য প্লাজমার প্রয়োজনীয় ঘনত্ব নির্ধারন করতে হবে। থেরাপিটি সফল হলে ভ্যাক্সিন আসার আগে সম্ভবত এটাই হবে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকরী চিকিৎসা। FDA এইমুহূর্তে যাচাই করছে যক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালগুলোতে পরীক্ষামুলকভাবে এই ব্লাড প্লাজমা-থেরাপি প্রয়োগ করা যায় কিনা। যুক্তরাজ্য, কানাডা সহ বিশ্বের অনেক দেশই ব্লাড-প্লাজমা ভিত্তিক চিকিৎসা বিবেচনা করছে।

৬) কোভিড-১৯ মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ড্রাগ ( Covid-19 Monoclonal Antibodies_AstraZeneca Plc, Eli Lilly & Co., Regeneron Pharma Inc. & Others): বিশ্বের অনেকগুলো কোম্পানীই এই মুহুর্তে যাচাই করছে কোন প্রানীদেহে কোভিড-১৯ ভাইরাসকে সংক্রমিত করে ঐ দেহে উৎপন্ন নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি সংগ্রহ করে আক্রান্ত রোগীকে অ্যান্টিবডি-থেরাপি দেয়া যায় কিনা। ‘এলি লিলি’ মে মাসের শেষ নাগাদ, ‘রিজেনেরন’ এই জুন এর মধ্যে এবং ‘অ্যাষ্ট্রাজেনেকা’ আগামী ৩-৫ মাসের মধ্যে হিউম্যান-ট্রায়াল শুরু করবে বলে ঘোষনা দিয়েছে।

৭) ইমিউন সিষ্টেম রিলাক্সিং ড্রাগ/পরোক্ষ থেরাপি (Immune System Relaxing Drug/ Indirect Therapies): এই ড্রাগগুলো করোনাভাইরাসজনিত শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া ও পরোক্ষ ইনফ্লেমেশন (Inflammation) প্রতিরোধে ‘কার্যকরী’ ভুমিকা রাখতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে:

• একটেমরা (Actemra_ Roche holding AG, Chugai Pharma Co.): কোভিড-১৯ রোগীর নিউমোনিয়া চিকিৎসার প্রাথমিক অবস্থায় ব্যবহারের লক্ষ্যে এই ড্রাগটির পৃথক ভাবে এবং অ্যান্টিভাইরাল ফ্লু ড্রাগ ‘অ্যাভিগান’ এর সাথে সমন্বিত-ড্রাগের একটি হিউম্যান ট্রায়াল এই মুহূর্তে পরিচালিত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে।

• কেভজারা (Kevzara_Sanofi, Regeneron Pharma Inc.): প্রচন্ড অসুস্থ রোগীর শ্বাস-কষ্ট উপশমের লক্ষ্যে ড্রাগটির একটা বড় ট্রায়ালের ফলাফল আগামী জুনে প্রকাশিত হবে।

• জাকাফি (Jakafi_ Novartis AG, Incyte Corp.): যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে কোভিড-১৯ রোগীর সংকটাপন্ন অবস্থায় ইমিউন সিষ্টেম এর ‘অতি-সক্রিয়তা’ (Over-Drive) জনিত মারাত্মক ইনফ্লেমেশন প্রতিরোধে ড্রাগটি ব্যবহারের ‘জরুরী’ অনুমোদন প্রদান করেছে।

• ডেক্সামিথাসন (Dexamethasone): কোভিড-১৯ রোগীর বিভিন্ন মাত্রার ইনফ্লেমেশন প্রতিরোধে এই ড্রাগটি কার্যকর হবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের ‘রিকভারি’ ট্রায়ালে এই ড্রাগটি ব্যবহৃত হচ্ছে।

• ব্যারিসিটিনিব (Baricitinib_Eli Lilly & Co.): যুক্তরাষ্ট্র, এশিয়া, ইউরোপে পরিচালিত এই ‘অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি’ ড্রাগটির হিউম্যান ট্রায়ালের ফলাফল এই জুনেই প্রকাশিত হবে।

• কলশিচিন (Colchicine): কানাডায় পরিচালিত এই ‘অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি’ (Anti-Inflammatory) ড্রাগটির ফেজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল আগামি সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হবে। মোট কথা, কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসায় প্রস্তাবিত ‘সম্ভাবনাময়’ ড্রাগগুলোর প্রাথমিক বা সীমিত ট্রায়ালের ফলাফল এখন পর্যন্ত যথেষ্ট ‘সন্তোষজনক’ বা ‘সিদ্ধান্তমুলক’ নয়- আরো ব্যাপক ট্রায়াল্ভিত্তিক ফলাফল-বিশ্লেষণ প্রয়োজন। আশার কথা হল WHO পরিচালিত আন্তর্জাতিক ‘সলিডারিটি’ ট্রায়াল, যুক্তরাজ্যের বৃহৎ ‘রিকভারি’ ট্রায়াল, চীন, জাপান, উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পরিচালিত ব্যাপক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল আগামী ৩-৪ মাসের মধ্যেই প্রকাশিত হবে। এছাড়া ব্লাড-প্লাজমা ও অ্যান্টিবডি ড্রাগের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফলও এবছরের শেষ নাগাদ হাতে আসবে। এমুহুর্তে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছেনা এ ‘সম্ভাবনাময়’ ড্রাগ/থেরাপিগুলোর কোনটি শেষ পর্যন্ত প্রকৃতই ‘কার্যকরী’ হয়ে উঠবে কিনা। তবুও ধারনা করা যায় কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসার একটি ‘কার্যকরী’ ড্রাগ বা থেরাপি খুজে পেতে এই সন্মিলিত বৈশ্বিক প্রচেষ্টাটি অব্যহত থাকবে – অন্তত একটি কার্যকরী ভ্যাক্সিন হাতে না আসা পর্যন্ত! অচিরেই কোভিড-১৯ চিকিৎসার একটি কার্যকরী ড্রাগ বা থেরাপি উদ্ভাবিত হোক-সাধারন চিকিৎসায় রোগী সুস্থ হয়ে উঠুক, লক-ডাউনের বিধিনিষেধ উঠে গিয়ে স্বাভাবিক কর্ম চাঞ্চল্যে মুখরিত হোক সারা পৃথিবী, সচল হয়ে উঠুক বিশ্ব-অর্থনীতি- সময়ের এই প্রত্যাশা!

লেখক : ডঃ মোহম্মদ মাহবুব চৌধুরী কানাডার অটোয়াস্থ কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয় হতে রসায়নে পিএইচডি সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী-
NXP Semiconductor Inc. এ External Quality Engineer হিসেবে কর্মরত আছেন। এর আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর রসায়ন বিভাগ হতে বিএসসি (সম্মান) এবং এমএসসি সম্পন্ন করে প্রায় তিন বছর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে শিক্ষকতা করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ