ফাঁস হওয়া জাতিসংঘ নথি: করোনাভাইরাসে মারা যেতে পারেন ২০ লাখ বাংলাদেশি

ভোরের আলো ডেষ্ক: সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন মতে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে করোনাভাইরাসে বাংলাদেশে বিশ লাখ পর্যন্ত মানুষ মারা যেতে পারেন বলে আশঙ্কা করেছে জাতিসংঘের ফাঁস হওয়া একটি নথি, যদিও সরকারি তথ্যমতে গত তিন দিনে দেশে মাত্র নতুন একজন রোগী শনাক্ত হয়েছেন।

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সরকারের প্রস্তুতি-ঘাটতির সমালোচনা রয়েছে দেশের ভেতরেই। এমন পরিস্থিতিতে সুইডেন ভিত্তিক নিউজপোর্টাল নেত্রনিউজ জাতিসংঘের ‘কান্ট্রি প্রিপেয়ার্ডনেস অ্যান্ড রেসপন্স প্লান’ শীর্ষক ফাঁস হওয়া ওই নথিটির ওপর ভিত্তি করে গত শনিবার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

বাংলাদেশে কর্মরত জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, সরকার, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাসমূহ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যৌথভাবে ওই নথিটি তৈরি করেছে বলে নেত্র নিউজকে জানান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঢাকা অফিসের প্রধান বর্দান জাং রানা।

দৃশ্যত খসড়া ওই নথিটি গত সপ্তায় ঢাকায় কর্মরত কূটনীতিকদের কাছে বিতরণ করা হয়েছে বলেও জানায় নেত্র নিউজ।

“অস্বাভাবিক জনঘনত্বের বাংলাদেশে, বৈশ্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য মডেল কৌশল ও পরিমাপকসূচক অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ছাড়া কোভিড-১৯ মহামারিতে আনুমানিক পাঁচ থেকে বিশ লাখ পর্যন্ত মানুষ প্রাণ হারাতে পারেন। অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করলে এই সংখ্যাটি বিস্ময়কর নয়,” বলা হয় ওই নথিতে।

এতে বলা হয়, “বাংলাদেশের সমস্যার মূলে রয়েছে দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা, মহামারির শুরুর দিকে তা মোকাবেলায় পূর্ণ সক্ষমতার ঘাটতি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উপযুক্ত স্বাস্থ্য পরিসেবার বাইরে সম্ভাব্য রোগীদের কোভিড-১৯ মহামারির ঝুঁকির মধ্যে ফেলে রাখা।”

বেনারনিউজের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে জাতিসংঘ বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোনো কর্তৃপক্ষ নথিটির সত্যতা যেমন অস্বীকার করেননি, তেমনি নথিটি তাঁদের সংস্থার বলে স্বীকারও করেননি কেউ।

এদিকে নেত্র নিউজের প্রতিবেদন সম্পর্কে কিছু উল্লেখ না করে জাতিসংঘের ঢাকা দপ্তর থেকে শনিবার প্রকাশিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ‘কান্ট্রি প্রিপেয়ার্ডনেস অ্যান্ড রেসপন্স প্লান’ নথিটি সম্পর্কে একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়।

এতে বলা হয় এই নথিটি “একটি পরিকল্পনা নথি, যা জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথভাবে প্রস্তুতকৃত।”

বৈশ্বিক মডেলিং কৌশল ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়া হলে, ভাইরাসটির সম্ভাব্য বিস্তার কতটুকু হতে পারে তা অনুমান করার জন্যই এই নথিটি ব্যবহার করা হয় বলে জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে।

এতে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সরকারের উদ্যোগকে সহায়তা করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী বিভিন্ন সংস্থাকে দিকনির্দেশনা দেওয়াই এই নথিটি তৈরির মূল উদ্দেশ্য।

ফাঁস হওয়া জাতিসংঘের এই নথিটি দেখেছেন বলে বেনারকে নিশ্চিত করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন। তবে এ ধরনের নথি প্রকাশ করা জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি বলেন, “এ ধরনের নথি প্রকাশ করা জাতিসংঘ সনদের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন। আইনানুযায়ী, জাতিসংঘ এরকম কোনো নাথি প্রচার করার আগে আমাদের সরকারের সাথে আলোচনা করার কথা। আমরা সম্মতি দিলে তবেই তারা প্রচার বা বিতরণ করতে পারে।”

“তারা আমাদেরকে এই নথিটি দেখায়নি। তাদের এর ধরনের আইন লঙ্ঘনের ঘটনায় আমরা খুবই মর্মাহত,” বলেন আব্দুল মোমেন।

এদিকে জাতিসংঘের গোপন নথি ফাঁস হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম নয় বলে বেনারকে জানান সাবেক রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সাবেক চেয়ারম্যান মুনশি ফায়েজ আহমেদ।

“জাতিসংঘের নাথিগুলো নিজেদের মধ্যে ব্যবহারের জন্য। এগুলো সকলের জন্য নয়,” মন্তব্য করে তিনি বলেন “আমার মনে হয় কেউ ইচ্ছা করে এটি ফাঁস করেছে।”

নথিটি সত্যায়নের ব্যাপারে জাতিসংঘ সংস্থাগুলোর অনীহার প্রসঙ্গে মুনশি ফায়েজ বলেন, “জাতিসংঘ নথিটি সত্যায়িত করবে না, স্বীকারও করবে না। আমি তাদের অবস্থানে থাকলে আমিও করতাম না।”

“যদি তারা স্বীকার করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ উত্থাপিত হতে পারে,” বলেন মুনশি ফায়েজ।

‘সবার নমুনা পরীক্ষার দরকার নেই’

গত ডিসেম্বরের শেষে চীন থেকে করোনাভাইরাস ছড়ানো শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব মতে, সোমবার পর্যন্ত সারা বিশ্বে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ৭ লাখ ৭৫ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন ৩৭ হাজারের বেশি।

বাংলাদেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে মারা গেছেন পাঁচজন। আর সোমবার শনাক্ত এক জনসহ মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৪৯ জন।

শনি ও রবিবার দেশে করোনাভাইরাসের কোনো রোগী পাওয়া যায়নি বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর পরিচালক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা।

এদিকে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সরকারের দেয়া এই তথ্য গ্রহণ করছেন না। তাঁরা বলছেন, রোগতত্ব বিভাগের পরীক্ষা করার পদ্ধতি সঠিক নয়। আর এভাবে ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব বাড়তে পারে।

তবে রোগতত্ব বিভাগের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এএসএম আলমগীর বেনারকে বলেন, “আমরা বিজ্ঞানের বাইরে যাই না। আমরা রোগীদের রক্ত পরীক্ষা করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আমেরিকার সিডিসির প্রটোকল পুরোপুরি অনুসরণ করি। সবার নমুনা পরীক্ষা করার দরকার নেই।”

তিনি বলেন, “আমরা পরীক্ষা করে যদি কোনো পজিটিভ না পাই তাহলে কি মিথ্যা বলব?”

“কোনো মানুষের যদি জ্বর, সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট হয় তাহলেই তিনি কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত নন। আমাদের এখানে ডেঙ্গু আছে, ইনফ্লুয়েঞ্জা আছে, শ্বাসকষ্টের রোগী আছেন,” সোমবার বেনারকে বলেন ডা. ফ্লোরা।

তিনি বলেন, “কোনো সন্দেহভাজন রোগী আমাদের সাথে যোগাযোগ করলে আমরা তাঁদের কথা শুনি, তাঁদের প্রকৃতই কোভিড-১৯ রোগী হওয়ার সমূহ সম্ভবনা আছে কি না তা বুঝতে।”

এদিকে জাতিসংঘের ফাঁস হওয়া নথিটি দেখেছেন জানিয়ে ডা. আলমগীর বলেন, ওই প্রতিবেদন নিয়ে বিচলিত হওয়ার দরকার নেই।

“তারা (জাতিসংঘ) বিভিন্ন দেশের ব্যাপারে বলেছিল যে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ মারা যাবে। কিন্তু তাদের পূর্বাভাস সত্য হয়নি। জাতিসংঘের এই পূর্ভাবাসে আমাদের বিচলিত হওয়ার দরকার নেই,” বলেন ডা. আলমগীর।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিস্তৃত। যদি প্রত্যন্ত অঞ্চলে একজন মানুষও কোভিড-১৯ এর লক্ষণ, যেমন জ্বর-শ্বাসকষ্টে মারা যায় তাহলে আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীরা আমাদের খবর দেবে।”

‘সরকারি তথ্য প্রকৃত চিত্র নয়

ঢাকার হেলথ অ্যাণ্ড হোপ হাসপাতালের প্রধান ডা. এম এইচ চৌধুরী লেলিন বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে করোনাভাইরাস রোগীর যে সংখ্যা আইইডিসিআর’র পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে সেটি একদম ঠিক নয়।”

গত ৮ মার্চ থেকে সোমবার পর্যন্ত আইইডিসিআর মাত্র ১৩৩৮টি নমুনা পরীক্ষা করে ৪৯ জন রোগী পেয়েছে জানিয়ে ডা. লেলিন বলেন, “আইইডিসিআর শুধু যাদের বিদেশ যাওয়ার ইতিহাস আছে তাঁদের রক্ত পরীক্ষা করছে। কিন্তু তাদের সিদ্ধান্ত সঠিক নয়।”

উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, “ঢাকার টোলারবাগে এক ব্যক্তি করোনাভাইরাসের সকল উপসর্গ নিয়ে আইইডিসিআর’এ ফোন দিয়েছিলেন রক্ত পরীক্ষার জন্য। তাঁর বিদেশ যাওয়ার অথবা বিদেশ থেকে ফিরেছেন এমন কারও সংস্পর্শে আসেননি এমন কথা জেনে আইডিসিআর থেকে বলা হয় যে, তাঁর রক্ত পরীক্ষা করার দরকার নেই।”

“ওই ব্যক্তি অসুস্থ শরীর নিয়ে নামাজ পড়েছেন। দুদিন পর তাঁকে ডেলটা হাসপাতালে ভর্তির পর তিনি মারা যান। মৃত্যুর পর নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেলো তিনি করোনাভাইরাসে মারা গেছেন,” বলেন ডা. লেলিন।

তিনি বলেন, “তাহলে লাভ কী হলো? মৃত্যুর পরে নমুনা পরীক্ষা করার কোনো মানে নেই। এভাবে কম পরীক্ষা করে কম রোগীর সংখ্যা দেখানো মানে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঘটতে সুযোগ করে দেয়া।”

বাংলাদেশ বিরাট বিপদের মধ্যে আছে উল্লেখ করে ডা. লেলিন বলেন, “প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া না হলে বাংলাদেশে পাঁচ থেকে ২০ লাখ মানুষ মারা যাবে বলে জাতিসংঘের এমন পূর্বাভাস দেয়ার কারণ হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারকে সাম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত করা।”

বেশি মানুষকে পরীক্ষা করতে পারলে বাংলাদেশে আরো অনেক বেশি সংখ্যক করোনাভাইরাসের রোগী পাওয়া যেত বলে বেনারকে জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া।

তিনি বলেন, “আইইডিসিআর’র উচিত আরও বেশি মানুষের রক্ত পরীক্ষা করা, যার মাধ্যমে প্রকৃত অবস্থা জানা যাবে।”

“কোভিড-১৯ এর বিস্তার আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তাই আমাদের উচিত, জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থার সাথে একযোগে কাজ করা,” বলেন অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া।

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ