দীন ইসলাম: এই মুহুর্তে দেশ বিদেশে আলোচিত নাম শামীমা নূর পাপিয়া। সদ্য যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী। এক সময় যাকে দেখলে এতদিন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপিসহ সবাই হেসে ছবি তুলতেন। ছোট করে ‘সার্ভিস’ চাইতেন। এখন পাপিয়ার নাম নিলেই নাক ছিটকান। নানা কথা বলেন। যেন পাপিয়াকে চিনেনই না। পাপিয়ার মধুকুঞ্জের খদ্দের ছিলেন এমন ২১ মন্ত্রী, এমপি, সিনিয়র আমলা ও ব্যবসায়িদের নাম পেয়েছে ভোরের আলো। ঢাকার ণ্ডলশানের হোটেল ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষের সরবরাহ করা সিসি টিভি ফুটেজ, পাপিয়ার কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া গোপন ভিডিও থেকে এসব রাঘব বোয়ালদের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন তদন্তকারিরা সংস্থাণ্ডলো।
পাপিয়ার ডেরায় যাওয়া খদ্দেরদের তালিকায় পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব লোকমান হোসেন ভূইয়া, বাণিজ্য সচিব জাফর উদ্দিন, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি ও এমপি পঙ্কজ দেবনাথ, সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের পরিচালক মোহাম্মদ এ আরাফাত, পরিসংখ্যা ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব সৌরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিরুজ্জামান, প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আশরাফুল আলম খোকন, ঠাকুরগাঁও-২ আসনের সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলাম, এফবিসিসিআই পরিচালক বজলুর রহমান, দিনাজপুর-১ আসনের এমপি মনোরঞ্জন শীল গোপাল, নীলফামারী-৩ আসনের এমপি রানা মোহাম্মদ সোহেল, সাবেক এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী ও জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা এমপি, কুষ্টিয়া-১ আসনের এমপি সেলিম আলতাফ জর্জ, মাগুরা-১ আসনের সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখর, ময়মনসিংহ ১০ আসনের এমপি ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল, নেত্রকোনা-৩ আসনের এমপি অসীম কুমার উকিল, মানিকগঞ্জ-১ আসনের এমপি নাইমুর রহমান দুর্জয়, ঢাকা-১৪ আসনের এমপি আসলামুল হক, বাংলাদেশ নিট ডাইং ওনার্স এসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি জিএম হায়দার আলী এবং ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের মালিক দীলিপ কুমার আগারওয়ালা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাপিয়ার আস্তানায় এসব ব্যক্তিরা নিয়মিত যেতেন। টেন্ডারবাজ ঠিকাদার জি কে শামীমও নিয়মিত যেতেন সেখানে। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা থেকে আওয়ামী দলীয় নেতা, ব্যবসায়ীরা পাপিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।
রাশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত ও নেপাল থেকে উঠতি তরুণী আনতেন পাপিয়া:
পুলিশের রিমান্ডে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন বহিষ্কৃত যুব মহিলা লীগ নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ। তার সঙ্গে গ্রেপ্তার তার স্বামী সুমন এবং দুই সহযোগী সাব্বির ও তায়্যিবাও ণ্ডরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি)। তাদের তথ্যানুযায়ী, দেশ-বিদেশ থেকে উঠতি তরুণীদের দিয়ে রাজধানীতে অপরাধের জাল বুনেছিলেন পাপিয়া। শুধু তাই নয় বিদেশ থেকে উঠতি মডেল ও তরুণীও ভাড়ায় আনা হত। তাদের অভিজাত হোটেলে পাঠিয়ে দিয়ে ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালীদের ব্ল্যাকমেইল করতেন পাপিয়া ও তার স্বামী। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। ডিবিতে জিজ্ঞাসাবাদে পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন চৌধুরী অনেক তথ্য দিয়েছেন। কখনও আলাদাভাবে, কখনও দু’জনকে মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। রিমান্ডে তাদের দুই সহযোগী সাব্বির ও তায়্যিবাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করে ণ্ডরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। পাপিয়া ও সুমন চৌধুরীর অপরাধ জগত সম্পর্কে তায়্যিবা ডিবিকে জানিয়েছেন, অনেক সময় চাহিদামত থাইল্যান্ড, নেপাল, ভারত, ভুটান ও রাশিয়া থেকে উঠতি বয়সী তরুণীদের নিয়ে আসা হতো। পার্বত্য অঞ্চল থেকেও পাহাড়ি মেয়েদের নিয়ে আসতেন পাপিয়া। ক্ষমতাবান ও বিত্তশালীদের ব্ল্যাকমেইল করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে পাপিয়া দেশ-বিদেশের উঠতি মডেলদেরও ব্যবহার করতেন। বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়ে আসতেন মডেলদের। মোটা অঙ্কের লেনদেন হতো মডেলদের সঙ্গে। মডেলদের বাংলাদেশে এনে কিছু দিন রেখে আবার পাঠিয়ে দেয়া হতো। মডেলদের বিমান ভাড়া দিতে হতো মোটা অঙ্কের টাকা। শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে এক মাস আগে রাশিয়ার কয়েকজন মডেলও নিয়ে এসেছিলেন পাপিয়া। এর পর ইমিগ্রেশন থেকে ওই মডেলদের আটকে দেয়া হয়। কারণ তারা বাংলাদেশে আসার নির্দিষ্ট কারণ বলতে পারেননি। এর পর শামীমা নূর পাপিয়া বিভিন্ন ক্ষমতাশালীকে দিয়ে ওই মডেলদের বের করে নিতে সক্ষম হন। এ বিষয়ে র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, পাপিয়ার বিদেশ থেকে মডেল আনার খবর আমরাও শুনেছি। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত আমরা কিছুই জানি না। আমরা এই মামলার তদন্তভার চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। তদন্তের দায়িত্ব পেলে আমরা এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব। সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, আমাদের কাছে পাপিয়ার বিরুদ্ধে ব্ল্যাকমেইলসহ নানা ধরনের অভিযোগ ছিল। আমাদের গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আমরা তার ব্যাপারে বিস্তারিত জেনেছি। এর পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এদিকে গ্রেপ্তারের পর পরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় বাইজি সর্দারনী বেশে পাপিয়ার ভিডিও। ইতিমধ্যে তার অপরাধমূলক কর্মকান্ডের কথা বের হতে শুরু করেছে। মুখ খুলতে শুরু করেছেন সাধারণ মানুষ। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও পতিতা ব্যবসার পাশাপাশি ব্ল্যাকমেইল করে পাপিয়া এবং তার স্বামী গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। অনৈতিক কার্যকলাপের ভিডিও ধারণ করে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিতেন তারা। অপরাধে জড়িয়ে পড়া যুব মহিলা লীগ নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়াকে ইতিমধ্যে সংগঠন থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। র্যাব জানায়, অনৈতিক কর্মের ভিডিও ধারণ করে ব্যবসায়ীদের ব্ল্যাকমেইল করতেন। এ দুই উপায়ে তিনি শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। অস্ত্র ও মাদক মজুদের পাশাপাশি কিউঅ্যান্ডসি নামে ক্যাডার বাহিনীও গঠন করেছেন। তিনি জানান, পুলিশের এসআই ও বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভিন্ন পদে মানুষকে চাকরি দেয়ার কথা বলে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন। শুধু তাই নয়, জমির দালালি, সিএনজি পাম্পের লাইসেন্স দেয়া, গ্যাস লাইন সংযোগের নামেও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন তারা। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ রেখেছেন এই দম্পতি। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের ব্যাংকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত থাকার কথা জানা গেছে। র্যাবের দাবি, পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন চৌধুরী রেলওয়ে ও পুলিশে চাকরির প্রলোভনে ১১ লাখ টাকা, একটি কারখানায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেয়ার কথা বলে ৩৫ লাখ টাকা, একটি সিএনজি পাম্পের লাইসেন্স করে দেয়ার কথা বলে ২৯ লাখ টাকা নিয়েছেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর বাইরে নরসিংদী এলাকায় চাঁদাবাজি, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছেন তারা। এর আগে যুব মহিলা লীগ নরসিংদী জেলার সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়াকে গত ২২শে ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করে র্যাব। রাজধানীর একটি পাঁচতারকা হোটেলে আস্তানা তৈরি করে নারী, মাদক অস্ত্র ব্যবসাসহ নানা অনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে আসছিলেন। ণ্ডরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও প্রভাবশালীদের মনোরঞ্জনের জন্য পাপিয়া রাশিয়া, থাইল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশ থেকে সুন্দরী তরুণীদের নিয়ে আসতেন। অনৈতিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি তার আস্তানায় আসা ব্যক্তিদের গোপন ভিডিও সংগ্রহ করে তা প্রকাশের ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায়েরও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।