বিজিবির মহাপরিচালক “ক্যাসিনো জেনারেল”

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক হিসেবে মেজর জেনারেল সাফিনুল ইসলাম বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের একজন। চোরাচালান ও মাদক বাণিজ্যের মতো আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমনের দায়িত্বে থাকা আধাসামরিক সীমান্তরক্ষী বাহিনীটির শীর্ষ অধিনায়ক হলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে ডেপুটেশনে বা প্রেষণে যাওয়া এই টু স্টার (দুই তারকা) জেনারেল। কিন্তু বিজিবিরই কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তার অভিযোগ যে জেনারেল সাফিন কুখ্যাত এক “ক্যাসিনো ডনে”-র “গডফাদার” বা প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ওই ক্যাসিনো ডন সম্প্রতি বেশ নাটকীয়ভাবে ঢাকায় আটক হন। তার সেই আটকের খবর বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় ফলাও করে প্রচারও হয়েছিল।

বিজিবির কয়েকজন কর্মকর্তা নেত্র নিউজের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করেন। নিজেদের বক্তব্যের প্রমাণ হিসেবে তারা কিছু ভিডিও ও ছবি সরবরাহ করেন। বাংলাদেশের প্রধামন্ত্রীর কাছে লেখা একটি চিঠির অনুলিপিও তারা আমাদের দিয়েছেন। বিজিবির “বিভিন্ন ইউনিটের সৈনিকবৃন্দ” স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বিজিবি মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে। ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহের প্রসঙ্গ টেনে চিঠিটিতে বলা হয়েছে যে বর্তমানে এই আধাসামরিক বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ বিরাজ করছে। আমাদের সংবাদসূত্রের গোপনীয়তা বজায় রাখতে ও তাদের নিরাপত্তা রক্ষার্থে আমরা ওই বিজিবি কর্মকর্তাদের পদবী ও কর্মস্থল প্রকাশ করছি না।

বিজিবির এই হুইসেলব্লোয়াররা আমাদের তিনটি ভিডিও ক্লিপ ও বেশ কয়েকটি ছবি দিয়েছেন। সেখান থেকে স্পষ্টতই মেজর জেনারেল সাফিনুল ইসলামের সাথে “ক্যাসিনো ডন” সেলিম প্রধানের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়টি বোঝা যায়। গত বছর ৩০ই সেপ্টেম্বর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি বিমান থেকে নামিয়ে সেলিম প্রধানকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে অবৈধ অনলাইন জুয়ার ব্যবসা পরিচালনার অভিযোগ আনে র‍্যাব। তখনই বাংলা সংবাদমাধ্যমে তাকে নিয়ে অনেকগুলো প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে অভিযোগ আনা হয় যে সীমান্ত অঞ্চলে গরু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তিনি চাঁদাবাজি করতেন, এছাড়া সীমান্তে চোরাচালানের সঙ্গেও তিনি সম্পৃক্ত। কিছু প্রতিবেদনে আকারে-ইঙ্গিতে “প্রশাসনের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি”-র কথা উল্লেখ করা হয়, যিনি কিনা সেলিম প্রধানের অপরাধ সাম্রাজ্যের দুই পৃষ্ঠপোষক বা গডফাদারদের একজন।

সেলিম প্রধানের দুই গডফাদার যে মেজর জেনারেল সাফিনুল ইসলাম এবং সাবেক যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুর রহমান মারুফ (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই), এই দাবির প্রমাণ হিসেবে বেশ কিছু ছবি নেত্র নিউজের কাছে এসেছে। শেখ মারুফ ও সেলিম প্রধানের সম্পর্কের বিষয়টি ইতিমধ্যেই বাংলা সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। তবে ঢাকার ক্রাইম রিপোর্টারদের কয়েকজন নেত্র নিউজকে বলেছেন যে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা কাঠামোতে জেনারেল সাফিনের অত্যন্ত ক্ষমতাশালী অবস্থানের কারণে তারা সেলিম প্রধানকে নিয়ে করা প্রতিবেদনগুলোতে এই জেনারেলের নাম উল্লেখ করার সাহস করেননি।

বাম থেকে : সেলিম প্রধান , শেখ ফজলুর রহমান মারুফ , মেজর জেনারেল সাফিনুল ইসলাম

ঢাকায় নেত্র নিউজের এক প্রতিবেদকের সাথে আলাপচারিতায় অভিযোগকারী বিজিবি কর্মকর্তাদের একজন জেনারেল সাফিনকে বারবার “ক্যাসিনো জেনারেল” হিসেবে সম্বোধন করেছেন। সেলিম প্রধানের অনলাইন জুয়া ব্যবসায় সাফিনের অংশীদারিত্ব রয়েছে অভিযোগ করে তাকে এই নামে ডাকেন ওই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, “এইটার তদন্ত করা হোক, এবং এরে চাকরিচ্যুত করে জেলে ঢুকানো হোক। একজন সেনা অফিসার এইরকম হইতে পারেনা, এইরকম ক্যাসিনো জেনারেল হইতে পারেনা।”

নেত্র নিউজকে দেওয়া একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা গেছে যে, সেলিম প্রধান কৌতুকের ছলে বিজিবি মহাপরিচালককে “ক্রিমিনাল” বলে ডাকছেন। আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায় সেলিম প্রধান ও জেনারেল সাফিন একসঙ্গে নৌকায় চড়ছেন। জেনারেলের কাঁধে হাত রেখে এই “ক্যাসিনো ডন” মোবাইলে ভিডিও কল করেন। সেখানে তিনি একজনকে ইংরেজিতে বলেন, “শুভ সকাল! আমরা এখন ভোলাতে আছি। বেবি, এদিকে দেখো, আমি আর সাফিন। তুমি চারদিকের দৃশ্য দেখতে পাচ্ছ? এটি বাংলাদেশের প্রকৃতি। ওই নৌকাটা দেখো। আমরা ওই নৌকা দিয়ে এসেছি। আমরা এখন নৌকায় ফিরে যাচ্ছি।”


নেত্র নিউজের সাংবাদিকরা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছেন যে সেলিম প্রধানকে আটকের পর তার ফোন থেকেই এই দুইটি ক্লিপ উদ্ধার করে র‍্যাব। তবে বিজিবির যে কর্মকর্তারা ক্লিপগুলো আমাদের দিয়েছেন তারা কীভাবে সেগুলো পেয়েছেন তা স্পষ্ট নয়। আমাদের হাতে আসা তৃতীয় আরেকটি ভিডিও ক্লিপের সত্যতা সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি।

বিজিবির কর্মকর্তারা আমাদের কাছে আরও অভিযোগ করেছেন যে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালকের সহযোগী হিসেবে সেলিম প্রধান সীমান্ত অঞ্চলে চোরাচালান ও চাঁদাবাজি চক্র চালাতেন। এই দাবির প্রমাণ হিসেবে তারা বেশ কিছু ছবি আমাদেরকে দিয়েছেন। এসব ছবিতে সেলিম প্রধানকে রাজশাহী ও সিলেট সেক্টরের বিভিন্ন সীমান্ত চৌকিতে উর্দি পরিহিত বিজিবি কর্মকর্তাদের সাথে দেখা যায়। ওই কর্মকর্তারা জেনারেল সাফিনের নির্দেশে সীমান্ত চৌকিতে সেলিম প্রধানের ঘন ঘন সফরের ব্যবস্থা করেছেন। আমরা ছবিতে থাকা বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার পরিচয় শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। এদের মধ্যে একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলও আছেন যিনি একটি সীমান্ত রিজিয়নের কমান্ডার। আমাদের কাছে ওই কর্মকর্তাদের কয়েকজনের সঙ্গে সেলিম প্রধানের হোয়াটসঅ্যাপ ও ভাইবার আলাপচারিতার অংশবিশেষও এসেছে। তবে এসব কথোপকথনের সত্যতা আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি।

আন্তঃসীমান্ত চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত সেলিম প্রধানের সাথে রাজশাহী অঞ্চলের বিজিবি কর্মকর্তারা।

এর আগে বাংলা সংবাদমাধ্যমে আসা খবরে রাজশাহী অঞ্চলে গরু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি ও আন্তঃসীমান্ত চোরাচালানে সেলিম প্রধানের সম্পৃক্ততা থাকার অভিযোগ এসেছিল। কয়েকটি প্রতিবেদনে সিলেটের সীমান্ত অঞ্চলে দুর্নীতিগ্রস্থ বিজিবি কর্মকর্তাদের সহায়তায় সেলিম প্রধানের অবৈধ পাথর ব্যবসা পরিচালনার অভিযোগও করা হয়। নেত্র নিউজের সাথে যেসব বিজিবি কর্মকর্তারা যোগাযোগ করেছেন, তাদের অভিযোগ যে এইসব অবৈধ কর্মকাণ্ডে সেলিম প্রধানকে সরাসরি সহায়তা করেছেন জেনারেল সাফিন, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রধান হিসেবে তিনিই সেলিম প্রধানকে সুরক্ষা দিতেন।

বিজিবির প্রোটেকশন ডিটেইল নিয়ে সীমান্ত অঞ্চলে ঘুরছেন সেলিম প্রধান।

প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে বিজিবির “বিভিন্ন ইউনিটের সৈনিকবৃন্দ” তাদের মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি দুর্নীতির অভিযোগের বর্ণনা দিয়েছেন। এর মধ্যে কুখ্যাত “ক্যাসিনো আসামি” সেলিম প্রধানের সাথে জেনারেল সাফিনের সম্পর্ক থাকার কথাও উল্লেখ করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এসব অভিযোগ তদন্ত করে জেনারেল সাফিনকে বিজিবি প্রধানের দায়িত্ব থেকে সরানোর দাবি জানানো হয় চিঠিতে। এতে বলা হয়, “‘আমরা বিজিবি সৈনিকরা আমাদের মহাপরিচালককে এরকম দুষ্টচক্রের একজন সদস্য হিসেবে মানি না এবং মহাপরিচালক হিসেবে তাকে মানি না।” চিঠিতে এই ইঙ্গিতও দেওয়া হয় যে জেনারেল সাফিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ বাহিনীর মধ্যে ব্যপক অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতির সাথে ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহের পূর্ববর্তী অসন্তোষ তুলনীয় বলে মন্তব্য করা হয় চিঠিতে।

প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো চিঠির কিছু অংশ।

আনীত অভিযোগগুলোর বিষয়ে মন্তব্য চেয়ে মেজর জেনারেল সাফিনুল ইসলামের কাছে তার ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) এবং এইড-ডি-ক্যাম্পের (এডিসি) মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন পাঠিয়েছে নেত্র নিউজ। আমরা এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর পাইনি। র‍্যাবের মুখপাত্রের কাছে এই প্রতিবেদনের বিষয়ে মন্তব্য চেয়ে বার্তা পাঠালেও তিনিও কোনো উত্তর দেননি।●

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ