আমার স্বপ্ন অলিম্পিকে দেশকে একটা পদক উপহার দেব: রোমান

শেষ হতে যাওয়া বছরে ফুটবলে খারাপ কাটেনি বাংলাদেশের। ক্রিকেটে নানা রকম নেতিবাচক ঘটনা থাকলেও এ বছরই বহুজাতিক টুর্নামেন্টে প্রথমবারের মতো শিরোপার স্বাদ নিয়েছে বাংলাদেশ। দুটি ইভেন্টেই অনেক খেলোয়াড় ব্যক্তিগত সাফল্যে ভাস্বর ছিলেন। বিশেষ করে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। বিশ্বকাপে তার পারফরম্যান্স ছিল অতিমানবীয়। ফুটবলার জামাল ভূঁইয়াও বাংলাদেশ দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তবে দ্য ডেইলি স্টারের ক্রীড়া বিভাগ ২০১৯ সালের ‘সেরা ক্রীড়া তারকা’ হিসেবে অপেক্ষাকৃত কম জনপ্রিয় ইভেন্ট আর্চারির রোমান সানাকে বেছে নিয়েছে।

এ বছর এশিয়া কাপ-ওয়ার্ল্ড র‍্যাঙ্কিং আর্চারিতে ব্যক্তিগত রিকার্ভে স্বর্ণ পদক জিতেছেন রোমান। সবচেয়ে বড় কথা, বিশ্ব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করে দ্বিতীয় বাংলাদেশি খেলোয়াড় হিসেবে যোগ্যতার বলে আগামী ২০২০ টোকিও অলিম্পিকে সরাসরি জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। বছরের শেষটাও ছিল দুর্দান্ত। দক্ষিণ এশিয়ান (এসএ) গেমসে আর্চারি ইভেন্টের সবকটি (১০টি) স্বর্ণ বাংলাদেশে আনার পথে রোমান একাই জিতে নেন তিনটি স্বর্ণ পদক। এমন দুর্দান্ত সাফল্যের পর বছরের শেষ প্রান্তে রোমান বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন দ্য ডেইলি স্টারের ক্রীড়া প্রতিবেদক রামিন তালুকদারের কাছে। তার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য-

প্রশ্ন: দ্য ডেইলি স্টারের ক্রীড়া সাংবাদিকদের বিশ্লেষণে আপনাকে ২০১৯ সালে বাংলাদেশের বর্ষসেরা সেরা ক্রীড়াবিদ নির্বাচিত করা হয়েছে। দেশে ক্রিকেট এত জনপ্রিয়, এ বছর ফুটবলেও বেশ কিছু ইতিবাচক দিল ছিল। তারপরও সাকিব আল হাসান, জামাল ভূঁইয়াদের ছাপিয়ে আপনি বছরের সেরা খেলোয়াড়।আর্চারির মতো কম পরিচিত ও কম জনপ্রিয় ইভেন্ট থেকে। আপনার অনুভূতি কেমন?

রোমান: এটা আমার জন্য বড় পাওয়া। আলহামদুলিল্লাহ। এটা অবশ্যই বড় সন্মানের ব্যাপার যে দেশের বড় বড় খেলোয়াড়দের পেছনে ফেলে আপনাদের সেরা হতে পেরেছি। খুশির ভাষা তো বর্ণনা করতে পারব না। আমার জন্য আপনারা দোয়া করবেন। আমি যেন আরও ভালো ভালো ফল করতে পারি। দেশকে আরও অনেক কিছু এনে দিতে পারি।

প্রশ্ন: এ বছর এত এত সাফল্য। গেল জুনে বিশ্ব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে পুরুষ রিকার্ভ এককে ব্রোঞ্জ পদক জিতে আগামী বছরের টোকিও অলিম্পিকে সরাসরি জায়গা করে নেওয়া। এরপর সেপ্টেম্বরে এশিয়া কাপ-ওয়ার্ল্ড র‌্যাঙ্কিং টুর্নামেন্টে (স্টেজ-৩) স্বর্ণ পদক, সবশেষ এসএ গেমসে স্বর্ণ পদক। কেমন লাগছে?

রোমান: আসলে, আমি যখন একটা কিছু অর্জন করি, তখন নতুন আরেকটা লক্ষ্য তৈরি করি যে এটা হয়ে গিয়েছে, এবার আমাকে এটা পেতে হবে। আরও ভালো করতে হবে। সব সময় চেষ্টা করি নতুন নতুন কিছু অর্জন করার। চেষ্টা করি, যতগুলো গেমস খেলব, যতগুলো ইভেন্ট খেলি, তাতে যেন কমপক্ষে একটা পদক থাকে।

প্রশ্ন: শেষ হতে যাওয়া বছরে অনেক প্রাপ্তি আপনার। কোনো আক্ষেপ রয়েছে কি?

রোমান: সব থেকে আক্ষেপ ছিল যেটা ন্যাশনাল রিকার্ভ এককে  সোনা জিততে ন পারা। আমার কিছু ভুল ছিল। যদি আমি আরেকটু যত্নবান হতাম, তাহলে হয়তো এমনটা হতো না। সর্বোপরি এটা থেকে আমি ভালো শিক্ষাও নিয়েছি।

প্রশ্ন: আপনি এক সময় ক্রিকেটও ভালো খেলতেন। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ছেড়ে আর্চারিতে আসার পেছনে কোনো গল্প রয়েছে কি?

রোমান: ভালো ক্রিকেট খেলতাম। তবে ওইভাবে চিন্তা ছিল না যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আসব। তখন বড় ভাইদের সঙ্গে খেলতাম পাড়াতে, ক্লাবে। সব জায়গায় খেলা হতো। কিন্তু ওইভাবে ক্রিকেট নিয়ে বড় চিন্তা করিনি। ক্রিকেটে গেলে হয়তো এত সফল হতাম না।

প্রশ্ন: তাহলে আর্চারিই কেন বেছে নিলেন? কীভাবে?

রোমান: ২০০৮ সালের কথা। তখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। স্কুলের সহ-সভাপতি হাসান স্যারের হাত ধরেই আর্চারিতে আসা। আসলে নতুন কিছু শেখার সব সময়ই ইছা জাগত। ছোটবেলায় কিন্তু অনেক (তীর-ধনুক) খেলেছি। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে সূতলি পেঁচিয়ে। ওই থেকে আগ্রহ জাগা। এছাড়া আরেকটা ব্যাপার ছিল, এখানে দলগত ইভেন্ট থেকে ব্যক্তিগত ইভেন্টে সফল হওয়ার সুযোগ বেশি। ব্যক্তিগত ইভেন্টে আপনি যত পরিশ্রম করবেন, তত ভালো ফল পাবেন। এসব দিকও চিন্তা-ভাবনায় ছিল।

প্রশ্ন: পরিবার থেকে কতটুকু সমর্থন পেয়েছেন?

রোমান: পরিবার থেকে শতভাগ সমর্থন পেয়েছি। বাবা প্রথম দিকে অবশ্য বলতেন, ক্রিকেট-ফুটবল খেললে ভালো হতো। যেহেতু আগে খেলতাম। কিন্তু আম্মা সব সময় অনেক সমর্থন দিতেন। বলতেন, এটাতে লেগে থাক। ইনশাআল্লাহ, ভালো কিছু হবে।

প্রশ্ন: স্বপ্নটা কবে থেকে অনেক বড় হলো?

রোমান: ২০১৪ সালে। যখন আমি থাইল্যান্ডে ‘প্রথম এশিয়ান আর্চারি গ্রাঁ প্রিঁ’তে স্বর্ণ পদক জয় করি, তখন থেকে। তখন আমি অলিম্পিকে পদক পাওয়া অনেক সিনিয়র আর্চারকে হারিয়েছিলাম। সেমি-ফাইনালে যখন উঠেছি, তখন থেকেই মনে হচ্ছিল, দারুণ কিছু হবে। ভালো করার বাসনাটা তখন থেকেই আরও তীব্র হয়েছে। তখন থেকেই ভেবেছি, তারা যদি পারে, তাহলে আমি কেন পারব না।

প্রশ্ন: আপনার এই পর্যায়ে আসার পেছনে জার্মান কোচ মার্টিন ফ্রেডরিখের অবদান অনেক।

রোমান: সত্যি বলতে, আমার সফলতার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদানটা আসলে তার। শুধু আমি নই, গোটা বাংলাদেশ আর্চারি দলের উন্নতি উনারই অবদান। কোচ হিসেবে যা যা গুণ থাকা দরকার, সবই রয়েছে তার ভেতরে।

প্রশ্ন: বিশ্ব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে পদক জিতে অলিম্পিকে যাওয়াটা বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে অনন্য এক ঘটনা। যার সুবাদে আপনি এখন বিশ্বের ১০ নম্বর তারকা আর্চার।নিজেকে ছাড়িয়ে আরও কত উঁচুতে দেখতে চান?

রোমান: সেরা তিনে দেখতে চাই। আর তার জন্য অল-র‍্যাঙ্কিং টুর্নামেন্টগুলো বেশি বেশি খেলতে হবে। যেমন- ওয়ার্ল্ড কাপের মতো ইভেন্ট খেললে র‍্যাঙ্কিংয়ে এগোনোর সুযোগ থাকে।

প্রশ্ন: যে কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে খেলার আগে আপনি বরাবরই বলে থাকেন, পদক পাওয়া কঠিন কাজ। পরে দেখা যায়, ঠিকই পেয়ে গিয়েছেন। অলিম্পিকেও কি এমন কোনো চমক দেখবে?

রোমান: আমার ব্যক্তিগত লক্ষ্য কোয়ার্টার ফাইনাল। কিন্তু অলিম্পিক অনেক বড়। এখানে অনেক বড় বড় খেলোয়াড় থাকবেন। তাই আগে থেকে বলাটা অনেক কঠিন। সবসময় আমি সেরাটা খেলার চেষ্টা করি। তবে আল্লাহ সহায় থাকলে ভালো কিছু হবে।

প্রশ্ন: ১৯৭২ সাল থেকে অলিম্পিকে অংশ নিলেও এখন পর্যন্ত কোনো পদক জিততে পারেনি বাংলাদেশ। তাহলেআমরা কি আশা করতে পারি যে আপনার হাত ধরে সে খরা কাটবে?

রোমান: আমারও স্বপ্ন যে আমি অলিম্পিকে একটা পদক অর্জন করব। দেশকে উপহার দেব। দেখেন, অলিম্পিক তো অনেক বড় একটা আসর। আর আমার জন্য এটা প্রথম। পৃথিবীর সর্বোচ্চ ক্রীড়া আসর এটি। যেহেতু আমি প্রথমবারের মতো যাচ্ছি, এটা আমার কাছে একটু অবিশ্বাস্যই মনে হচ্ছে। আর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমি কিছু বলছি না। আমি চেষ্টা করব আরও কঠোর পরিশ্রম করতে। নিজেকে পদক জয়ের যোগ্যতায় নিয়ে যেতে। আশা করছি, আমি একা না পারলেও আমার সতীর্থ যারা আছেন, সবাই মিলেও যেন বাংলাদেশকে একটা পদক এনে দিতে পারি।

প্রশ্ন: ২০০২ সালে কমনওয়েলথ গেমসে ভারতের অভিনব বিন্দ্রাকে হারিয়ে বাংলাদেশের আসিফ হোসেন খান শুটিংয়ে স্বর্ণ জিতে বেজায় হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে আসিফ হারিয়ে যান, বিন্দ্রা অলিম্পিকে জেতেন স্বর্ণ। সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা সব সময়ই বিরাট চ্যালেঞ্জ। আপনি কীভাবে দেখেন বিষয়টাকে?

রোমান: পারফরম্যান্সের উত্থান-পতন থাকবেই। একটা বাজে সময় তো আসেই। যখন খারাপ হবে, তখন আমাকে সবাই উৎসাহ দেবেন যেন পরবর্তীতে আরও ভালোভাবে ফিরে আসতে পারি। আমাদের দেশে হয়-কি একটা ম্যাচ খারাপ খেললে সেটা নিয়ে লিখতে লিখতে খেলোয়াড়ের মন-মানসিকতা আরও খারাপ করে ফেলা হয়। ভালো করলে খুব বেশি বাহবা আর খারাপ করলে বাজেভাবে অপমানিত করা। কেউ সব সময় সফল হবে এটা ভুল কথা। আমাদের দেশের সবার প্রত্যাশা থাকে এমন যে- ও ভালো খেলে, ওকে ভালো করতেই হবে। এটা সবসময় হয় না। এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

প্রশ্ন: আপনাকে ঘিরেও অনেক প্রত্যাশা। সেটা চাপও বটে। এসব ক্ষেত্রে আপনার পরিকল্পনা কেমন থাকে?

রোমান: চাপ নিলেই চাপ। তবে আমি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করি। সবার প্রত্যাশা থাকবেই। আমি আমার কাজে মনযোগী থাকি।

প্রশ্ন: সবশেষে, ক্রিকেট নিঃসন্দেহে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। ফুটবল নিয়ে উন্মাদনাও কম নয়। আর্চারিকে কি সেই কাতারে উঠিয়ে আনা সম্ভব? হলে তা কেন এবং কীভাবে?

রোমান: হ্যাঁ, সম্ভব। যদি আমি অলিম্পিকে একটা পদক অর্জন করতে পারি। এছাড়া আমাদের সবার যে পারফরম্যান্স বর্তমানে রয়েছে, সেটা ধরে রেখে আরও কিছু অর্জন করতে পারলে অবশ্যই আর্চারিকে দেশের সেরা খেলার স্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ