ডিএসইতে ‘স্বেচ্ছাচারিতা’!

একের পর এক ‘স্বেচ্ছাচারিতা‘র অভিযোগ উঠছে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। চাকরির বিধিমালা (সার্ভিস রুল) লঙ্ঘন, শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনৈতিক সুবিধা নেয়া, পদোন্নতির ক্ষেত্রে যোগ্যদের বঞ্চিত করা, নিয়ন্ত্রণ সংস্থার নির্দেশনা না মানা, নিয়ম বহির্ভূত কর্মকর্তাদের বদলি- এমন নানা ধরনের স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে। ফলে কর্মকর্তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ক্ষোভ ও অসন্তোষ।

ডিএসই’র কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে দেশের প্রধান পুঁজিবাজারটিতে এমন স্বেচ্ছাচারিতা চলছে। ফলে কর্মকর্তাদের ভেতরে থাকা ক্ষোভ মাঝেমধ্যে প্রকাশও পাচ্ছে। ডিএসই’র শীর্ষ কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদ করে একজন সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম)- এর চাকরি ছাড়ার ঘটনাও ঘটেছে। শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডে জাড়িয়ে পড়ছেন অধীনস্ত কর্মকর্তাও।

ডিএসই’র কর্মকর্তাদের মতে, একজন ভারপ্রাপ্ত এমডি কিছুতেই ডিজিএম পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের বদলি করতে পারেন না। রুটিং দায়িত্ব পালন করাই তার মূল কাজ। পলিসি লেভেলে তিনি হাত দিতে পারেন না। এটি স্পষ্ট ডিএসই’র চাকরির বিধিমালার লঙ্ঘন।

প্রধান অর্থ কর্মকর্তা ভারপ্রাপ্ত এমডি হওয়ার পর এক মাস না যেতেই এ বদলি করা হয়। ডিএসইতে হঠাৎ কী এমন ঘটল যে, এমডি না থাকা অবস্থায় এমন বড় বদলির ঘটনা ঘটাতে হবে। এমন ঘটনায় ডিএসইতে কাজের পরিবেশ নষ্ট হবে- অভিযোগ ডিএসইর একাধিক কর্মকর্তার।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, ব্যবস্থাপনা থেকে মালিকানা পৃথকীকরণে ডি-মিউচ্যুয়ালাইজেশন স্কিমের পর দ্বিতীয় ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ২০১৬ সালের ২৯ জুন নিয়োগ পান কে এ এম মাজেদুর রহমান। যার মেয়াদ শেষ হয় গত ১১ জুলাই। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ডিএসই পর্ষদ থেকে মাজেদুর রহমানকে এমডি পদে পুনরায় নিয়োগ চেয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) আবেদন করা হয়। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডিএসই’র ওই প্রস্তাব বাতিল করে দেয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে নতুন এমডির খোঁজ করছে ডিএসই। এমডির শূন্য পদে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা আবদুল মতিন পাটোয়ারী ভারপ্রাপ্ত এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব পাওয়ার কিছুদিন পরই গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিভাগের ডিজিএম পদে পরিবর্তন আনেন মতিন পাটোয়ারী।

এর মধ্যে মানবসম্পদ বিভাগের ডিজিএম সৈয়দ আল আমিন রহমান-কে বদলি করে প্রডাক্ট অ্যান্ড মার্কেট ডেভেলপমেন্ট বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ডিএসই’র ট্রেনিং একাডেমির ইনচার্জ ও উপ-মহাব্যবস্থাপক হোসনে আরা পারভীন শিউলী-কে আনা হয়েছে মানবসম্পদ বিভাগে। কমন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের (সিএসডি) আব্দুল হান্নান ফকির-কে বদলি করে আনা হয়েছে হিসাব শাখায়।

এ বিষয়ে ডিএসই’র একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ডিএসই’র চাকরির বিধিমালায় ২-৪ বছরের মধ্যে অফিসার ও নন-অফিসার পদে পদোন্নতির কথা উল্লেখ থাকলেও অনেক কর্মকর্তাকে ১০ বছরের অধিক সময় ধরে কোনো পদোন্নতি দেয়া হয়নি। পদোন্নতির ক্ষেত্রে বরাবরই যোগ্য কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করে তোষামোদকারীদের বেছে নেয়া হয়েছে। এখন কমন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তাকে হিসাব শাখায় বসিয়ে দেয়া হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত এমডির ডিজিএম পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে বদলি বা বহিষ্কার করার ক্ষমতা নেই। এ ধরনের রদবদলে কাজের পরিবেশ নষ্ট হয়। বিএসইসি’র উচিত এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ডিএসই’র পদোন্নতি অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে প্রথম প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানান মোহাম্মদ ওবায়দুর হাসান। ২০১৭ সালে হিসাব বিভাগের সহকারী মহাব্যবস্থাপক পদে থেকে প্রতিবাদ করে তিনি চাকরি ছাড়েন। অবশ্য চাকরি ছাড়ার আগে তিনি বিএসইসিতে লিখিত অভিযোগও করেন। ওই অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, ডিএসই’র ব্যবস্থাপনা পর্ষদ ‘ডিএসই বোর্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রেজুলেশন- ২০১৩’ এবং ডিএসই সার্ভিস রুলস’র ৯.১.১ ও ৯.১.২ ধারা লঙ্ঘন করেছে।

ওবায়দুর হাসান অভিযোগ করেন, ডিএসই সার্ভিস রুলস’র ৯.১.১ ও ৯.১.২ ধারা অনুযায়ী, কর্মকর্তাদের পদোন্নতি হবে বার্ষিক কর্মদক্ষতা মূল্যায়নের ভিত্তিতে। যা বিভাগীয় প্রধানের সুপারিশের ভিত্তিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক অনুমোদন করবেন। কিন্তু সম্প্রতি ব্যবস্থাপনা পর্ষদের কিছু সদস্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ‘ভোট’ নিতে বাধ্য করেন। ব্যবস্থাপনা পর্ষদের কিছু সদস্যের এমন অবৈধ প্ররোচনায় প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে ‘ভোট’ পদ্ধতি সমর্থনযোগ্য ও প্রতিপালনযোগ্য নয়।

তিনি বিএসইসি-কে জানান, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ‘বোর্ড অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রেজুলেশন- ২০১৩’ এর ১০ (৫) ধারা অনুযায়ী, “স্বাধীন, সঠিক, স্বচ্ছ ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে স্টক এক্সচেঞ্জ পরিচালনা করা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব। সুতরাং এ ধারা অনুযায়ী কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে ‘ভোট’ সঠিক ও স্বচ্ছ পদ্ধতি নয়। তালিকাভুক্ত কোম্পানির নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে এমন অনৈতিক কার্যকলাপের উদাহরণ ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন পরবর্তী ডিএসই’র সুনাম ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।”

এরপর ডিএসই’র পদোন্নতিসহ আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটির সার্ভিস রুল করে দেয়ার উদ্যোগ নেয় বিএসইসি। বিএসইসি’র ওই উদ্যোগের মধ্যেই গত বছর আর একটি বিতর্কিত পদোন্নতির ঘটনা ঘটে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মতিন পাটোয়ারী ডিএসই’র প্রধান অর্থ কর্মকর্তা পদে যোগদানের পর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে কেপিআই (কি পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর) ভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করেন। এতে দীর্ঘদিন ধরে ডিএসইতে কাজ করা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি ও বেতন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এক ধরনের জটিলতা তৈরি হয় এবং কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়।

এরপরও কেপিআই ভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে ২০১৮ সালে ডিএসই’র প্রায় অর্ধশত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পদোন্নতি দেয়া হয়। তবে এক্ষেত্রেও যোগ্যদের বঞ্চিত হওয়ার রীতি অব্যাহত থাকে। কেপিআই ভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েও পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হন অনেকে।

সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্তদের বঞ্চিত করার পাশাপাশি কোটা ভিত্তিক পদোন্নতিতেও অনিয়ম করা হয়। ডিএসই’র কোটা ভিত্তিক পদোন্নতির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, একটি ডিপার্টমেন্ট থেকে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ পদোন্নতি হবে। তবে ২০১৮ সালে দেয়া পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো ডিপার্টমেন্টে পাঁচজনের মধ্যে দুজন, কোথাও সাতজনের মধ্যে তিনজন, আবার কোনো ডিপার্টমেন্টে ১২ জনের মধ্যে একজনকে পদোন্নতি দেয়া হয়।

এমন অনিয়মের মধ্যে চলতি বছর ডিএসই’র সার্ভিস রুলের একটি খসড়া তৈরি করে দিয়ে মতামত চায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। তবে বিএসইসি’র সেই আহ্বানে সাড়া দেয়নি পুঁজিবাজারটির নীতিনির্ধারকরা। বিএসইসি’র তৈরি করা খসড়া সার্ভিস রুলের ওপর কোনো মতামত না দিয়ে তা ফাইলবন্দি করে রেখে যান সাবেক এমডি মাজেদুর রহমান। এরপর বিষয়টি অনেকটা ধামাচাপা পড়া অবস্থায় রয়েছে।

এ বিষয়ে ডিএসই’র একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বিএসইসি’র তৈরি করা সার্ভিস রুল কর্মকর্তাদের জন্য ভালো হলেও তা সিএফও মতিন পাটোয়ারী এবং সিটিও জিয়াউল করিমের জন্য ভালো হবে না। কারণ ওই দুই কর্মকর্তা চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ পেয়ে পরবর্তীতে তা স্থায়ী করে নেন। কিন্তু তাদের বেতন আর সমন্বয় করা হয়নি। ফলে অতিরিক্ত সুবিধা নেয়ার পাশাপাশি প্রতি মাসে ওই দুই কর্মকর্তা অস্বাভাবিক বেতন-ভাতাও গ্রহণ করছেন। এখন বিএসইসি’র সার্ভিস রুল বাস্তবায়ন হলে তাদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা কমে যাবে।

 

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ